মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২২ অপরাহ্ন

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: ১০ বছরেও কান্না-আতঙ্ক থামেনি হতাহতের স্বজনদের

তোফায়েল হোসেন জাকির
  • প্রকাশের সময় : সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৩

তোফায়েল হোসেন জাকির : গত ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ধসে পড়েছিল রানা প্লাজা নামের নয় তলা ভবন। ১০ বছর আগের এইদিনে সাভারের সেই প্লাজা হয়ে উঠেছিলো দুঃখ-বেদনার এক শোকগাঁথা। এ ঘটনায় সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছিলেন। এর মধ্যে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার প্রায় ২০ জন শ্রমিক হতাহত হয়। আজও কান্না-আতঙ্ক থামেনি ওইসব পরিবারের স্বজনদের।

স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে রানা প্লাজা

সাদুল্লাপুর উপজেলার ভূমিহীন পঞ্চনন বাবুর মেয়ে স্মৃতিরাণী (২০)। নিজে জায়গা জমি কিনে ঘরবাড়ি করবেন, এমন স্বপ্নে পাড়ি দিয়েছিলেন ঢাকার সভার এলাকায়। বিধিবাম! ২০১৩ সালের এদিনে সেখানকার রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারিয়েছে স্মৃতিরানী। আজ রোববার (২৪ এপ্রিল) চোখেমুখে চরম হতাশার ছাপ নিয়ে এ তথ্য জানালেন নিহত স্মৃতিরাণীর মা সন্ধ্যারাণী। তার বাড়ি উপজেলার কিশামত দশলিয়া গ্রামে।

জানা যায়, ওই গ্রামের শ্রী পঞ্চনন বাবু। তিনি একজন ভূমিহীন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অন্যের জমিতে কোনোমতে বসবাস। স্মৃতিরাণীসহ তিন মেয়ে তার। নেই কোনো ছেলে সন্তান। মেয়েদের মধ্যে সবার বড় স্মৃতিরাণী। পিতার জন্য জায়জমি কিনে বসতবাড়ি স্থাপন করার স্বপ্নে স্মৃতিরানী পাড়ি দিয়েছিলেন ঢাকার সাভার এলাকায়। এরপর সেখানকার রানা প্লাজার পোষাক শিল্পে চাকুরি নেয়। ৭ম তলায় ফিনিসিং সেকশসনে হেলপার পদে কর্মরত ছিলেন। এরমধ্যে ঘটে যায় বিপত্তি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলে সাভারের রানা প্লাজা নামের ভবন ধসে প্রাণ হারায় স্মৃতিরানী। যেন নিমিষে স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে শ্রী পঞ্চনন বাবুর। স্বপ্নের এই সন্তানকে হারিয়ে এখনো বাকরুদ্ধ তিনি। শুধু পঞ্চনন বাবুই নয়, মাতা সন্ধ্যারানীরও একই অবস্থায় রয়েছে।

নিহত স্মৃতিরাণীর মা সন্ধ্যারানী জানান, পরিবারের একমাত্র ভরসা ছিল স্মৃতিরাণীর উপর। কিন্তু রানা প্লাজার ধসের ঘটনায় সবকিছুই এলোমেলো হয়েছে। ইচ্ছে ছিল মেয়ের বেতনের টাকা যোগার করে কয়েকশতক জায়গা কিনে ঘরবাড়ি করা হবে কিন্তু সেই ইচ্ছেটুকু পরণ হওয়ার আগেই স্মৃতিকে প্রাণ দিতে হয়েছে রানা প্লাজা ভবনে। এই মেয়েটির শোক নিয়ে এখনো অন্যের জমিতে বসবাস করতে হচ্ছে।

মা হারা সন্তানের ঠাঁই এখন দাদির কোলে

২০ বছর আগে এইদিনে ঢাকা সভারের রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবন ধসে পড়েছিল। এ ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন সাদুল্লাপুর উপজেলা দামোদরপুর ইউনিয়নের কিশামত দশলিয়া গ্রামের দিনমজুর সোনা মিয়ার স্ত্রী কামনা বেগম (২৫)। নিখোঁজের ১০ বছরেও  তাকে খুঁজে পাইনি কামনার একমাত্র ছেলে কামরুল ইসলাম। ৪ বছর বয়সে মা হারা হয়ে অতিকষ্টে বড় হচ্ছে দাদির কোলে।

জানা যায়. দরিদ্র পরিবারের সোনা মিয়ার স্ত্রী কামনা বেগম। পরিবারের অভাব ঘোচাতে চাকুরি নিয়েছিলেন রানা প্লাজায়। ভবনটির পঞ্চম তলার গার্মেন্টসের বি-লাইনে হেলপার হিসেবে কাজ করছিলেন। এ শিল্পে ৬ মাস চাকুরি করার পর ২০১৩ সালের ২৪  এপ্রিলে রানা প্লাজা ভবনটি ধসে পড়ে। এসময় ভবন ভাঙনের কবলে পড়ে নিখোঁজ হয় কামানা বেগম। এরপর স্বজনরা বিভিন্নভাবে খুঁজতে থাকে কামনাকে। ব্যাপক খোঁজাখুঁজি করার পরও তাকে জীবিত কিংবা মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। হৃদয় বিদারক এ ঘটনার ১০ বছর পার হলেও, স্বজনরা সন্ধান পায়নি কামনার। এ পরিবারের এই কামনাকে হারানোর শোকে বৃদ্ধা মা মফিজান বেগমের এখনো নির্ঘুম রাত কাটে।

কান্নাজড়িত কন্ঠে মফিজান বেগম জানান, মেয়ে কামানাকে হারানোর পর থেকে রাতে ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেন না। মাঝে মধ্যে এখনো ঢাকা সাভারে যান তিনি। সেখানে নানাভাবে খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন।

ছেলের কবরের পাশে এখনো কাদে মা

সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের মধ্য ভাঙ্গামোড় গ্রামের ওয়াহেদ আলী ও মনজিলা বেগম দম্পতির ছেলে সবুজ মিয়া  (২০) নামের এক পোশাক শ্রমিক রানা প্লাজা ধসে  নিহত হয়। এ ঘটনার ১০ বছর অতিবাহিত হলেও, আজও কান্না থামেনি ছেলে হারা মা মনজিলা বেগমের। আজও সবুজের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন তিনি। যেনো ছেলে হারা শোকে বাকরুদ্ধ অবস্থা তার।

জানা যায়, ওই প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন সবুজ মিয়া । ঘটনার দিন ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল যথানিয়মে কাজে গিয়েছিলেন। সেটাই যে তার কাজের শেষ দিন নিজেরও হয়তো জানা ছিল না। রানা প্লাজা ধসের ৭ দিন পর সবুজের মরদেহ খুঁজে  পায় স্বজনরা । এরপর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তার মরদেহ।

কান্নাজড়িত কন্ঠে মনজিলা বেগম জানান, সংসারের অভাব দূর করতে রানা প্লাজার পোশাক কারখানার হেলপার হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন ছেলে সবুজ মিয়া। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় তাকে লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। ছেলের স্মৃতি সবসময় খুঁজে বেড়ান তিনি। এভাবে যেন আর কারও সন্তান অকালে প্রাণ না হারায় সেটাই আশা করেন তিনি।

নিখোঁজ মেয়েকে আজও খোঁজে মা

১০ বছর আগে এইদিনে ঢাকা সভারের রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবন ধসের ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের মধ্য ভাঙ্গামোড় গ্রামের আব্দুল বারি ও আনজুয়ারা দম্পতির মেয়ে বিথি খাতুন (২০) নিখোঁজের ১০ বছরেও  তাকে খুঁজে পাইনি স্বজনরা। আজও এই মেয়ের সন্ধানে ছবি বুকে নিয়ে অঝড়ে কাঁদছেন আনজুয়ারা বেগম।

এখনো আতঙ্ক কাটেনি আহত দম্পতির

জীবনের ঘটে যাওয়া কিছু বেদনাবিধুর স্মৃতি, যা কখনই মুছে ফেলা যায় না। আট বছর আগের এইদিনে সাভারের রানা প্লাজা হয়ে উঠেছিলো দুঃখ-বেদনার এক শোকগাঁথা। এ প্লাজাটি ধ্বংসস্তপ থেকে প্রাণে উদ্ধার হয়েছিলেন সাদুল্লাপুর উপজেলার বাসিন্দা জিয়াউর রহমান ও মনিফা বেগম নামের এই দম্পতি। সেই ভয়বহ দুর্ঘটনার আতঙ্ক এখনো কাটেনি এ দম্পতির।

জানা যায়, ওই গ্রামের জিয়াউর রহমান তার স্ত্রী মনিফা বেগমকে নিয়ে দরিদ্রতার কষাঘাতে জীবনযান করছিলেন। বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছিলেন তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে রেহায় পেতে নানাভাবে স্বপ্ন দেখেন তারা। একপর্যায়ে উভয়ের সম্মতিতে দুজনে পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকার সাভার এলাকায়। এ এলাকার রানা প্লাজা নামক বহুতল ভবনের গার্মেমেন্টেসে চাকুরি নেয় স্বামী-স্ত্রী দুজনে। ভবনটির তৃতীয় তলার সুইং সেকসনের এ-লাইনে হেলপার হিসেবে কাজ করছিলেন মনিফা বেগম। একই তলায় ফিনিসিং সেকসনে প্যাকিংম্যানে কর্মরত স্বামী জিউয়ার রহমানও। সেখানে বেশ কয়েকমাস চাকুরি করার পর ঘটে যায় ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ঘটনা। ২০১৩ সালেল ২৪ এপ্রিল পৌনে নয়টার দিকে রানা প্লাজাটি ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছি। সেইদিন এ ঘটনায় সেদিনের কেউ হারিয়েছেন তার মাকে, কেউ তার বাবা, কেউ তার ভাই, কেউ বোন, কেউ তার স্ত্রী, কেউ আবার স্বামীকে। আর ইট-কংক্রিটের ধ্বংস্তুর চিপায় আটকা পড়ছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক। এসবের মধ্যে জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী মনিফা বেগমও আটকা পড়ছিলেন। আর ইট-খোয়ার আঘাতে মাথা ফেঁটে যায় জিউয়ার রহমানের। এসময় ভবন ধসে পড়া ছাদের ফাঁকে কোনোমতে শুয়ে ছিলেন তারা। সেখানে বসে থাকার সুযোগ ছিল না। যেন বুকের উপরে লেগে রয়েছে ছাদটি। সকাল থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত এক অন্ধকার অবস্থায় শুয়ে থাকতে হয়েছে তাদেরকে। জীবন বাঁচাতে কোনদিকে যাবেন, এমন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এরই মধ্যে উদ্ধার কর্মীদলের আওয়াজ শুনতে পান। কর্মীর কথামতে শুয়ে শুয়ে এগুতে থাকে জিউয়ার ও মনিফা। এরপর একটা ফাঁকা যায়গার ভেতর দিয়ে হাত উঠিয়ে দেওয়া হয়। এরমধ্যে উদ্ধার কর্মীরা তাদেরকে টেনে উপরে উঠায়। এভাবে প্রাণে বেঁচে যায় আহত দম্পতি জিয়াউর ও মনিফা।

এ বিষয়ে জিয়াউর রহমান ও মনিফা বেগম ঘটনার বর্ননা দিয়ে তারা বলেন, যেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। ভয়াবহ ওই ধ্বংসস্তুপের বেঁচে থাকা এক আশ্চর্য ব্যাপার। সয়ং আল্লাহপাক ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব হয়নি। সেই ঘটনার ১০ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো কাটেনি তাদের আতঙ্ক।

সাদুল্লাপুরের দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানান, রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনায় এ এলাকায় প্রায় ২০ জন শ্রমিক হতাহত হয়েছে। পরিষদের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর

© ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | জাগো২৪.নেট

কারিগরি সহায়তায় : শাহরিয়ার হোসাইন