রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উদ্যোক্তা তহমিনা বদলে দিয়েছে দেড়’শ নারীর ভাগ্য

আফসানা আক্তার মিমি: গেল করোনা মহামারিতে হারান পোশাক কারখানার চাকরি হারানা তহমিনা বেগম (৩০)। ওই সময় ঢাকা থেকে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। এসময় হতাশ হয়ে পড়েন। ঠিক তখনই স্বপ্ন দেখেন নিজেকে ফের কর্মস্থানের পাশাপাশি অন্যান নারীদেরও। শুরু করেন দর্জির কাজ। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন- ‘দর্জি ভিলেজ’। এখন এখানই তহমিনাসহ ভাগ্য বদল করেছে শতাধিক নারী।

সম্প্রতি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার আব্দুল্লাহরপাড়ায় দেখা গেছে- উদ্যোক্তা তহমিনার ‘দর্জি ভিলেজ’ এর কর্মকাণ্ড। সেখানে আরও বেশ কিছু নারী কারিগর ও হেলপার হিসেবে কাজ করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের সহযোগিতায় কাজ শুরুর মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই তহমিনা প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘দর্জি ভিলেজ’ নামে একটি পোশাক তৈরীর কারখানা। সাঘাটার বোনারপাড়া সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে জুমারবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত আব্দুল্লাহরপাড়ায় বর্তমানে যেটি দর্জি ভিলেজ নামেই সমধিক পরিচিত। তহমিনা বেগমের এই বারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১৫০ জন নারীর। সববয়সী মানুষের জন্য পাঞ্জাবী তৈরিতে বেশ সুনাম রয়েছে এই ভিলেজের।

আরও জানা যায়, এই দর্জি ভিলেজের উদ্যোক্তা তহমিনা বেগম এক সময়ে করোনা মহামারিতে হারান পোশাক কারখানার চাকরি। ওই সময় ঢাকা থেকে গ্রামে এসে হতাশ হয়ে পড়েন। তখনই আশার আলো দেখায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সাঘাটা। সেখানে মাসব্যাপি নেন সেলাই প্রশিক্ষণ। এ কর্মসূচির আওতায় নিজের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে পান ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। আর এই টাকা থেকে কিনেন সাধারণ পোশাক সেলাই ও ওভার লকের মেশিন। শূন্য হাতে থাকলেও দেখেন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন। এরপর পেছনে না তাকিয়ে তহমিনা বেগম বিআরবিডি’র গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের থিম ‘এক পল্লী এক পণ্য’ মডেল কারখানা গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি থেকেই নেন ২ লাখ টাকা উদ্যোক্তা ঋণ। এরপর যেনো সেলাইয়ের মেশিনের মতোই ঘুরতে থাকে তাদের ভাগ্যের চাকা।

প্রথমে আব্দুল্লারপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতির ৩০ জন নিয়ে শুরু করেন এ কারখানা। পরে দক্ষিণ আব্দুল্লারপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতি ও পশ্চিম আমদিরপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতিসহ তিনটি সমিতির মোট দেড়’শ জন নারীদের নিয়ে ধুমছে চালাচ্ছেন এই পোশাক তৈরির ব্যবসা।

সরেজমিনে দেখা যায়, এই কারখানায় কাজ করছেন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী মিম আক্তার। তিনি বলেন, এখানে দৈনিক ৬০০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পেয়ে থাকি। ফলে পড়ালেখার খরচসহ নিজের আনুষঙ্গিক খরচের জন্য আর পরিবারের কাছে বলতে হয় না।

গৃহিনী লুবনা, সোনালী, নাসরিন বলেন, সকালে সংসারের কাজ করি। ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠাই। তারপর সবাইকে খাবার খাইয়ে এখানে সেলাইয়ের কাজ করতে আসি। এ থেকে মাসে ৮ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাই।

এসব নারী সদস্যদের প্রশিক্ষণসহ পোশাকের অর্ডার ও মার্কেটিংয়ে করছেন বলে জানালেন- গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের প্রশিক্ষক ও তহমিনা বেগমের স্বামী রুনু মিয়া।

এই উদ্যোক্তা তহমিনা বেগম জাগো২৪.নেট-কে বলেন, ঢাকা থেকে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন হাতে যেমন টাকা ছিলো না, তেমনি মাথার উপরও ছিলো না কোনো ছাদ। তারপরও আশা ছাড়ি নি। প্রশিক্ষণ শেষে এলাকার বোন-ভাবী, চাচীদের নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করি। প্রথম প্রথম তেমন অর্ডার আসতো না। আমরা সকলে খুব পরিশ্রম করতাম। আমার স্বামী, শ্বাশুড়ি, দুই ছেলেও আমাকে খুব মোটিভেশন দিয়েছেন। তবে, আমার স্বামীর অবদান অনেক। তিনিই আমদের এই কারখানার প্রচার-প্রসারে দৌড়-ঝাঁপ করেছেন। রংপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, বগুড়াসহ এলাকার অনেক অর্ডারের কাজ আমরা সফলতার সাথে শেষ করেছি। আমাদের কাজ সবাই খুব পছন্দ করেন।

তহমিনা বেগম আরও বলেন, শুরুতে তেমন আয় না হলেও এখন আমি কারখানার অন্য সদস্যদের পারিশ্রমিক দিয়েও মাসে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছি। তবে, এখন আমি আরও বড় পরিসরে কারখানা দিতে চাই। হাজার হাজার নারীকে স্বাবলম্বী করতে চাই। এজন্য বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, গাইবান্ধা’র সহযোগিতা চান এই নারী উদ্যোক্তা।

এ বিষয়ে সাঘাটা উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সামিউল ইসলাম জাগো২৪.নেট-কে বলেন, গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমরা বদ্ধপরিকর। তহমিনা বেগমের হাত ধরেই দর্জি ভিলেজের নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক বর্তমানে সাঘাটা উপজেলার নিভৃত এই পল্লীর নারীদের দক্ষ হাতে তৈরী পাঞ্জাবী, ফতুয়া, টি-শার্ট, টাউজারসহ বিভিন্ন পোশাক গাইবান্ধার গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায়।

জনপ্রিয়

উদ্যোক্তা তহমিনা বদলে দিয়েছে দেড়’শ নারীর ভাগ্য

প্রকাশের সময়: ০২:২৫:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

আফসানা আক্তার মিমি: গেল করোনা মহামারিতে হারান পোশাক কারখানার চাকরি হারানা তহমিনা বেগম (৩০)। ওই সময় ঢাকা থেকে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। এসময় হতাশ হয়ে পড়েন। ঠিক তখনই স্বপ্ন দেখেন নিজেকে ফের কর্মস্থানের পাশাপাশি অন্যান নারীদেরও। শুরু করেন দর্জির কাজ। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন- ‘দর্জি ভিলেজ’। এখন এখানই তহমিনাসহ ভাগ্য বদল করেছে শতাধিক নারী।

সম্প্রতি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার আব্দুল্লাহরপাড়ায় দেখা গেছে- উদ্যোক্তা তহমিনার ‘দর্জি ভিলেজ’ এর কর্মকাণ্ড। সেখানে আরও বেশ কিছু নারী কারিগর ও হেলপার হিসেবে কাজ করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের সহযোগিতায় কাজ শুরুর মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই তহমিনা প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘দর্জি ভিলেজ’ নামে একটি পোশাক তৈরীর কারখানা। সাঘাটার বোনারপাড়া সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে জুমারবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত আব্দুল্লাহরপাড়ায় বর্তমানে যেটি দর্জি ভিলেজ নামেই সমধিক পরিচিত। তহমিনা বেগমের এই বারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১৫০ জন নারীর। সববয়সী মানুষের জন্য পাঞ্জাবী তৈরিতে বেশ সুনাম রয়েছে এই ভিলেজের।

আরও জানা যায়, এই দর্জি ভিলেজের উদ্যোক্তা তহমিনা বেগম এক সময়ে করোনা মহামারিতে হারান পোশাক কারখানার চাকরি। ওই সময় ঢাকা থেকে গ্রামে এসে হতাশ হয়ে পড়েন। তখনই আশার আলো দেখায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সাঘাটা। সেখানে মাসব্যাপি নেন সেলাই প্রশিক্ষণ। এ কর্মসূচির আওতায় নিজের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে পান ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। আর এই টাকা থেকে কিনেন সাধারণ পোশাক সেলাই ও ওভার লকের মেশিন। শূন্য হাতে থাকলেও দেখেন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন। এরপর পেছনে না তাকিয়ে তহমিনা বেগম বিআরবিডি’র গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের থিম ‘এক পল্লী এক পণ্য’ মডেল কারখানা গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি থেকেই নেন ২ লাখ টাকা উদ্যোক্তা ঋণ। এরপর যেনো সেলাইয়ের মেশিনের মতোই ঘুরতে থাকে তাদের ভাগ্যের চাকা।

প্রথমে আব্দুল্লারপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতির ৩০ জন নিয়ে শুরু করেন এ কারখানা। পরে দক্ষিণ আব্দুল্লারপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতি ও পশ্চিম আমদিরপাড়া মহিলা পল্লী উন্নয়ন সমিতিসহ তিনটি সমিতির মোট দেড়’শ জন নারীদের নিয়ে ধুমছে চালাচ্ছেন এই পোশাক তৈরির ব্যবসা।

সরেজমিনে দেখা যায়, এই কারখানায় কাজ করছেন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী মিম আক্তার। তিনি বলেন, এখানে দৈনিক ৬০০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পেয়ে থাকি। ফলে পড়ালেখার খরচসহ নিজের আনুষঙ্গিক খরচের জন্য আর পরিবারের কাছে বলতে হয় না।

গৃহিনী লুবনা, সোনালী, নাসরিন বলেন, সকালে সংসারের কাজ করি। ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠাই। তারপর সবাইকে খাবার খাইয়ে এখানে সেলাইয়ের কাজ করতে আসি। এ থেকে মাসে ৮ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাই।

এসব নারী সদস্যদের প্রশিক্ষণসহ পোশাকের অর্ডার ও মার্কেটিংয়ে করছেন বলে জানালেন- গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের প্রশিক্ষক ও তহমিনা বেগমের স্বামী রুনু মিয়া।

এই উদ্যোক্তা তহমিনা বেগম জাগো২৪.নেট-কে বলেন, ঢাকা থেকে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন হাতে যেমন টাকা ছিলো না, তেমনি মাথার উপরও ছিলো না কোনো ছাদ। তারপরও আশা ছাড়ি নি। প্রশিক্ষণ শেষে এলাকার বোন-ভাবী, চাচীদের নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করি। প্রথম প্রথম তেমন অর্ডার আসতো না। আমরা সকলে খুব পরিশ্রম করতাম। আমার স্বামী, শ্বাশুড়ি, দুই ছেলেও আমাকে খুব মোটিভেশন দিয়েছেন। তবে, আমার স্বামীর অবদান অনেক। তিনিই আমদের এই কারখানার প্রচার-প্রসারে দৌড়-ঝাঁপ করেছেন। রংপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, বগুড়াসহ এলাকার অনেক অর্ডারের কাজ আমরা সফলতার সাথে শেষ করেছি। আমাদের কাজ সবাই খুব পছন্দ করেন।

তহমিনা বেগম আরও বলেন, শুরুতে তেমন আয় না হলেও এখন আমি কারখানার অন্য সদস্যদের পারিশ্রমিক দিয়েও মাসে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছি। তবে, এখন আমি আরও বড় পরিসরে কারখানা দিতে চাই। হাজার হাজার নারীকে স্বাবলম্বী করতে চাই। এজন্য বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, গাইবান্ধা’র সহযোগিতা চান এই নারী উদ্যোক্তা।

এ বিষয়ে সাঘাটা উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সামিউল ইসলাম জাগো২৪.নেট-কে বলেন, গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমরা বদ্ধপরিকর। তহমিনা বেগমের হাত ধরেই দর্জি ভিলেজের নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক বর্তমানে সাঘাটা উপজেলার নিভৃত এই পল্লীর নারীদের দক্ষ হাতে তৈরী পাঞ্জাবী, ফতুয়া, টি-শার্ট, টাউজারসহ বিভিন্ন পোশাক গাইবান্ধার গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায়।