সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন কতটা যৌক্তিক?

আওয়ামীলীগ সরকার যখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করে, তখন কতিপয় বিশেষজ্ঞ মনপ্রাণ দিয়ে সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন ( তাদের মধ্যে কেউ কেউ আগে থেকেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের দাবী করে্ আসছিলেন)। তাঁদের যুক্তি -‘ উন্নত বিশ্বে বহু আগে থেকেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে। এদেশে হলে সমস্যা কি!

এখন তারাই একতরফা নির্বাচন, দলীয় সন্ত্রাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছেন। তারা ভেবে দেখেন না যে, এদেশের মানুষ এখনও নাগরিক শ্রেণীতে উন্নীত হতে পারেন নি। চাপিয়ে দেয়া শাসন ব্যবস্থার কারণে; অথবা ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতার কারণে তারা সরকার কি, সরকার কীভাবে গঠিত হয়, সরকারের আয়-ব্যয় কোথা থেকে আসে ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী থাকেন না। বলা যায়, তাদের কাছে ‘সরকার’ এখনও দুরবর্তী প্রতিষ্ঠান । এখানে একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। সিলেটের লুৎফা বেগম নামে একজন কর্মঠ মহিলা বিএসসি নার্সিং পাশ করে গত ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি সেখানে ধাত্রী মাতা হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন। সেকারণে স্থানীয়রা তাকে ডিপুটি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করেন( বাঙালি হিসেবে তিনিই প্রথম ডিপুটি মেয়র )। ভোটররা লুৎফা বেগম কালো কি ফর্সা, লেবার দলের, না কনজারভেটিভ দলের, সেসব বিবেচনায় না নিয়ে তার কাজ দেখে ভোট প্রদান করেছেন। এদেশে ত্রুটিপুর্ণ সরকার ব্যবস্থার কারণে জনগণ স্থানীয় কাজকে ও জাতীয় কাজকে পৃথক করে দেখে না।

তারা অতি মাত্রায় জাতীয় রাজনীতি দ্বারা আক্রান্ত। সম্প্রতি আওয়ামীলীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, ‘প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলে মাঠ পর্যায়ে দলের ভিত মজবুত হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সাংগঠনিক ভিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইতিবাচক ফল দেয়। যার সুফল আওয়ামীলীগ পেয়েছে।’ প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন- ‘এতে ছোট খাট ঝামেলা হচ্ছে। তবে ইতিবাচক ফল দিচ্ছে’। আরেকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন-‘আমাদের কিছু নেতা কর্মী বুঝে হোক, না বুঝে হোক, দলীয় প্রতীক তুলে দেয়ার পক্ষে কথা বলছেন। তারা আসলে নিবন্ধনহীন জামাতের পক্ষে কাজ করছেন’। উল্লেখ্য, জামায়াত নিবন্ধনহীন হওয়ায় তারা নির্বাচন করতে পারছে না(বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ ফেব্রয়ারি)। তাহলে প্রমাণীত হলো, তারা স্থানীয় কাজের জন্য যোগ্য প্রতিনিধির চেয়ে দলের অনুগত ব্যক্তিদের নির্বাচিত করতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু বাস্তবে বিরুপ ফলাফল দেখা যাচ্ছে।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে দলে অন্তর্কলহ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলমান পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পর্যন্ত একাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আসন্ন ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশে আরও সহিংস ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাবনার পৌর নির্বাচন উদাহরণ হতে পারে। যুবলীগ নেতা আলী মুর্তজা সনি বিশ্বাস ÔনৌকাÕ প্রতীকে নির্বাচন করেন এবং আওয়ামীলীগের নিবেদিত কর্মী শরীফ উদ্দীন প্রধান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে Ôনারিকেল গাছ’ প্রতীকে নির্বাচন করেন। ভোট গণনায় দেখা যায় বিদ্রোহী প্রার্থী ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌আওয়ামীলীগের প্রার্থীর চেয়ে ১২২ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থাৎ দলের বহু নেতা-কর্মী বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করায় নৌকার পরাজয় ঘটেছে। মজার বিষয় হলো, পার্শ্ববর্তী চাটমোহর ও ঈশ্বরদী পৌর নির্বাচনে যারা নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন, তারা পাবনায় এসে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। কেন্দ্র থেকে বার বার হুশিয়ার করে বলা হয়েছে, যারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হবে।বাস্তবে যদি তাই করা হয় তাহলে পাবনার আওয়ামীলীগের ব্যাপক ক্ষতি হবে। আবার যারা দীর্ঘদিন যাবৎ নির্দলীয় অবস্থান থেকে সমাজসেবা করে যাচ্ছেন এবং তাদের কেউ কেউ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হতে চাচ্ছেন, এ ব্যবস্থার কারণে তারা নির্বাচন করতে অনাগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পুর্বে দেখা গেছে, কিছু নির্দলীয় সৎ ব্যক্তি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়ে এলাকার উন্নয়ন কাজ করে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন, তাদেরকে দলে টানার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল চেষ্টা করতো।

পাবনা পৌরসভায় বিগত ৭৮/৭৯ সালে বিরেশ মৈত্র (বিশিষ্ট কলাম লেখক রণেশ মৈত্রের সহোদর) চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হলেও দলমত নির্বিশেষে বহুলোক তাকে ভোট প্রদান করেছিলেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দেশের বহু জায়গায় এরকম উদাহারণ রয়েছে। উন্নত বিশ্বে বহু ব্যক্তি আছেন, যারা রাজনীতিকে পছন্দ করেন না। তারা নিজেদেরকে রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সে পরিচয়ে তারা বিভিন্ন সমাজ সেবা মুলক কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সেসব স্থানীয় কাজে সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করে থাকে। বর্তমানে দলের বাইরে থেকে সমাজসেবা মুলক কাজ করাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়(সম্প্রতি কটিয়াদী উপজেলায় নিজ স্ত্রীর নামে ক্লিনিক উদ্বোধন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য সচিব স্থানীয় আওয়ামীলীগের কর্মীদের দ্বারা নাজেহাল হয়েছেন) ।

এদেশের মানুষ দীর্ঘকাল আগে থেকেই স্থানীয়তে নির্দলীয়ভাবে বসবাস করে আসছে; তথা হাট-বাজারে যাওয়া, চায়ের দোকান ও বিভিন্ন ক্লাবে আড্ডা দেয়া, স্কুলে সন্তানদের নিয়ে যাওয়া, বিভিন্ন উৎসবে অংশগ্রহণ করা, প্রতিবেশির বিপদে ছুটে যাওয়া ইত্যাদি কাজগুলো তারা মিলেমিশেই করে থাকেন। যদিও সেখানে ক্ষুদ্রতা, আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীবাদিতা ইত্যাদি গ্রাম্য সংস্কৃতি রয়েছে। জাতীয় সরকারের কাজ হলো দীর্ঘকালের মুল্যবোধগুলো সংরক্ষণ করা এবং সেগুলোকে গণতান্ত্রিক করা। কিন্তু সেটা না করে যদি দলীয়করণ করা হয়, তাহলে ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠন হবে কীভাবে! সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার হওয়া জরুরি।

ধরা যাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র সংগঠনের সভাপতি/ সেক্রেটারি কে হবেন, মনোনীত প্রার্থী কে হবেন-সেটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন ঠিক করে দেয় না। শিক্ষক সমিতির বেলাতেও একই উদাহরণ খাটে। একইভাবে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি/সেক্রেটারি কে হবেন, তা সেখানকার নেতা-কর্মীরা বাছাই করবেন( পূর্বে তাই ছিল)। এখন তৃণমূল থেকে মতামত নেওয়া হলেও চুড়ান্ত মনোনয়ন দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা। সেক্ষেত্রে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা সমাধান দিতে পারে। তা হলো- জাতীয় সরকার আর স্থানীয় সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোতে দুই প্রকারের কমিটি থাকবে। একটি হবে জাতীয় কমিটি, অপরটি হবে স্থানীয় কমিটি। Ôজাতীয় কমিটি’ জাতীয় সরকারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধীতাকারী ব্যক্তিদের এবং Ôস্থানীয় কমিটি’ স্থানীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধীতা কারী ব্যক্তিদের বাছাই করবেন।

জাতীয় কমিটি কোনোক্রমেই স্থানীয় কমিটির উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানীয় কমিটির সদস্যরা জাতীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সে সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। Ôস্থানীয় নির্বাচন কমিশন’ স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং Ôজাতীয় নির্বাচন কমিশন’ জাতীয় সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন করবে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে Ôস্থানীয় নির্বাচন কমিশন’ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে Ôজাতীয় নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হবে ( উল্লেখ্য, প্রেসক্লাব, শিক্ষক সমিতি, ব্যবসায়ী সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাত্র সংসদ ইত্যাদির নির্বাচন উদাহরণ হতে পারে)।এ নিয়ম চালু হলে স্থানীয় ও জাতীয়তে একই সঙ্গে গণতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ শুরু হবে- তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

লেখকঃ গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।

জনপ্রিয়

দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন কতটা যৌক্তিক?

প্রকাশের সময়: ০৬:০৬:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ মার্চ ২০২১

আওয়ামীলীগ সরকার যখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করে, তখন কতিপয় বিশেষজ্ঞ মনপ্রাণ দিয়ে সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন ( তাদের মধ্যে কেউ কেউ আগে থেকেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের দাবী করে্ আসছিলেন)। তাঁদের যুক্তি -‘ উন্নত বিশ্বে বহু আগে থেকেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে। এদেশে হলে সমস্যা কি!

এখন তারাই একতরফা নির্বাচন, দলীয় সন্ত্রাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছেন। তারা ভেবে দেখেন না যে, এদেশের মানুষ এখনও নাগরিক শ্রেণীতে উন্নীত হতে পারেন নি। চাপিয়ে দেয়া শাসন ব্যবস্থার কারণে; অথবা ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতার কারণে তারা সরকার কি, সরকার কীভাবে গঠিত হয়, সরকারের আয়-ব্যয় কোথা থেকে আসে ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী থাকেন না। বলা যায়, তাদের কাছে ‘সরকার’ এখনও দুরবর্তী প্রতিষ্ঠান । এখানে একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। সিলেটের লুৎফা বেগম নামে একজন কর্মঠ মহিলা বিএসসি নার্সিং পাশ করে গত ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি সেখানে ধাত্রী মাতা হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন। সেকারণে স্থানীয়রা তাকে ডিপুটি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করেন( বাঙালি হিসেবে তিনিই প্রথম ডিপুটি মেয়র )। ভোটররা লুৎফা বেগম কালো কি ফর্সা, লেবার দলের, না কনজারভেটিভ দলের, সেসব বিবেচনায় না নিয়ে তার কাজ দেখে ভোট প্রদান করেছেন। এদেশে ত্রুটিপুর্ণ সরকার ব্যবস্থার কারণে জনগণ স্থানীয় কাজকে ও জাতীয় কাজকে পৃথক করে দেখে না।

তারা অতি মাত্রায় জাতীয় রাজনীতি দ্বারা আক্রান্ত। সম্প্রতি আওয়ামীলীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, ‘প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলে মাঠ পর্যায়ে দলের ভিত মজবুত হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সাংগঠনিক ভিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইতিবাচক ফল দেয়। যার সুফল আওয়ামীলীগ পেয়েছে।’ প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন- ‘এতে ছোট খাট ঝামেলা হচ্ছে। তবে ইতিবাচক ফল দিচ্ছে’। আরেকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন-‘আমাদের কিছু নেতা কর্মী বুঝে হোক, না বুঝে হোক, দলীয় প্রতীক তুলে দেয়ার পক্ষে কথা বলছেন। তারা আসলে নিবন্ধনহীন জামাতের পক্ষে কাজ করছেন’। উল্লেখ্য, জামায়াত নিবন্ধনহীন হওয়ায় তারা নির্বাচন করতে পারছে না(বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ ফেব্রয়ারি)। তাহলে প্রমাণীত হলো, তারা স্থানীয় কাজের জন্য যোগ্য প্রতিনিধির চেয়ে দলের অনুগত ব্যক্তিদের নির্বাচিত করতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু বাস্তবে বিরুপ ফলাফল দেখা যাচ্ছে।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে দলে অন্তর্কলহ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলমান পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পর্যন্ত একাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আসন্ন ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশে আরও সহিংস ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাবনার পৌর নির্বাচন উদাহরণ হতে পারে। যুবলীগ নেতা আলী মুর্তজা সনি বিশ্বাস ÔনৌকাÕ প্রতীকে নির্বাচন করেন এবং আওয়ামীলীগের নিবেদিত কর্মী শরীফ উদ্দীন প্রধান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে Ôনারিকেল গাছ’ প্রতীকে নির্বাচন করেন। ভোট গণনায় দেখা যায় বিদ্রোহী প্রার্থী ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌আওয়ামীলীগের প্রার্থীর চেয়ে ১২২ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থাৎ দলের বহু নেতা-কর্মী বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করায় নৌকার পরাজয় ঘটেছে। মজার বিষয় হলো, পার্শ্ববর্তী চাটমোহর ও ঈশ্বরদী পৌর নির্বাচনে যারা নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন, তারা পাবনায় এসে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। কেন্দ্র থেকে বার বার হুশিয়ার করে বলা হয়েছে, যারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হবে।বাস্তবে যদি তাই করা হয় তাহলে পাবনার আওয়ামীলীগের ব্যাপক ক্ষতি হবে। আবার যারা দীর্ঘদিন যাবৎ নির্দলীয় অবস্থান থেকে সমাজসেবা করে যাচ্ছেন এবং তাদের কেউ কেউ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হতে চাচ্ছেন, এ ব্যবস্থার কারণে তারা নির্বাচন করতে অনাগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পুর্বে দেখা গেছে, কিছু নির্দলীয় সৎ ব্যক্তি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়ে এলাকার উন্নয়ন কাজ করে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন, তাদেরকে দলে টানার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল চেষ্টা করতো।

পাবনা পৌরসভায় বিগত ৭৮/৭৯ সালে বিরেশ মৈত্র (বিশিষ্ট কলাম লেখক রণেশ মৈত্রের সহোদর) চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হলেও দলমত নির্বিশেষে বহুলোক তাকে ভোট প্রদান করেছিলেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দেশের বহু জায়গায় এরকম উদাহারণ রয়েছে। উন্নত বিশ্বে বহু ব্যক্তি আছেন, যারা রাজনীতিকে পছন্দ করেন না। তারা নিজেদেরকে রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সে পরিচয়ে তারা বিভিন্ন সমাজ সেবা মুলক কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সেসব স্থানীয় কাজে সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করে থাকে। বর্তমানে দলের বাইরে থেকে সমাজসেবা মুলক কাজ করাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়(সম্প্রতি কটিয়াদী উপজেলায় নিজ স্ত্রীর নামে ক্লিনিক উদ্বোধন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য সচিব স্থানীয় আওয়ামীলীগের কর্মীদের দ্বারা নাজেহাল হয়েছেন) ।

এদেশের মানুষ দীর্ঘকাল আগে থেকেই স্থানীয়তে নির্দলীয়ভাবে বসবাস করে আসছে; তথা হাট-বাজারে যাওয়া, চায়ের দোকান ও বিভিন্ন ক্লাবে আড্ডা দেয়া, স্কুলে সন্তানদের নিয়ে যাওয়া, বিভিন্ন উৎসবে অংশগ্রহণ করা, প্রতিবেশির বিপদে ছুটে যাওয়া ইত্যাদি কাজগুলো তারা মিলেমিশেই করে থাকেন। যদিও সেখানে ক্ষুদ্রতা, আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীবাদিতা ইত্যাদি গ্রাম্য সংস্কৃতি রয়েছে। জাতীয় সরকারের কাজ হলো দীর্ঘকালের মুল্যবোধগুলো সংরক্ষণ করা এবং সেগুলোকে গণতান্ত্রিক করা। কিন্তু সেটা না করে যদি দলীয়করণ করা হয়, তাহলে ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠন হবে কীভাবে! সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার হওয়া জরুরি।

ধরা যাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র সংগঠনের সভাপতি/ সেক্রেটারি কে হবেন, মনোনীত প্রার্থী কে হবেন-সেটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন ঠিক করে দেয় না। শিক্ষক সমিতির বেলাতেও একই উদাহরণ খাটে। একইভাবে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি/সেক্রেটারি কে হবেন, তা সেখানকার নেতা-কর্মীরা বাছাই করবেন( পূর্বে তাই ছিল)। এখন তৃণমূল থেকে মতামত নেওয়া হলেও চুড়ান্ত মনোনয়ন দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা। সেক্ষেত্রে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা সমাধান দিতে পারে। তা হলো- জাতীয় সরকার আর স্থানীয় সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোতে দুই প্রকারের কমিটি থাকবে। একটি হবে জাতীয় কমিটি, অপরটি হবে স্থানীয় কমিটি। Ôজাতীয় কমিটি’ জাতীয় সরকারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধীতাকারী ব্যক্তিদের এবং Ôস্থানীয় কমিটি’ স্থানীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধীতা কারী ব্যক্তিদের বাছাই করবেন।

জাতীয় কমিটি কোনোক্রমেই স্থানীয় কমিটির উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানীয় কমিটির সদস্যরা জাতীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সে সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। Ôস্থানীয় নির্বাচন কমিশন’ স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং Ôজাতীয় নির্বাচন কমিশন’ জাতীয় সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন করবে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে Ôস্থানীয় নির্বাচন কমিশন’ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে Ôজাতীয় নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হবে ( উল্লেখ্য, প্রেসক্লাব, শিক্ষক সমিতি, ব্যবসায়ী সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাত্র সংসদ ইত্যাদির নির্বাচন উদাহরণ হতে পারে)।এ নিয়ম চালু হলে স্থানীয় ও জাতীয়তে একই সঙ্গে গণতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ শুরু হবে- তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

লেখকঃ গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।