অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান দার্শনিক হেগেল বলতেন যে আধুনিক মানুষের উপাসনা হচ্ছে সকালবেলার সংবাদপাঠ। ছাপা সংবাদপত্রের খবর অপরিবর্তনীয়। তাই এ সংবাদপত্র পাঠকের বিশেষ আস্থার জায়গা। এ আস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সংবাদকর্মীকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। তাজা ও প্রামাণ্য সংবাদ পরিবেশনের জন্য তাকে সততা, মেধা, পরিশ্রম ও ঝুঁকির সমন্বয় ঘটাতে হয়। প্রতিনিয়ত ছুটতে হয় নতুন নতুন প্রশ্ন নিয়ে। তিনি একদিকে যেমন প্রশ্ন খুঁজে বেড়ান আবার একই সঙ্গে তার উত্তরও তুলে আনার চেষ্টা করেন।
সংবাদ ও সাংবাদিকতায় এখন নানা প্লাটফর্ম যুক্ত হয়েছে। অনলাইন পোর্টালের সঙ্গে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন পাঠকের সংবাদ চাহিদা পূরণ করছে। স্মার্টফোন এসব যোগাযোগমাধ্যমকে মানুষের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী করে তুলেছে। মানুষ সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমেই সংবাদ আদান-প্রদান করছে। এ পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হলেও এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে এর সীমাবদ্ধতাগুলো দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে। সম্পাদনা, অনুসন্ধান ও যুক্তিপ্রমাণহীন সংবাদ রূপ নিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে। এভাবে প্রামাণ্য সংবাদের চেয়ে গুজব, অর্ধসত্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর ছড়িয়ে পড়েছে, যা উসকে দিচ্ছে সহিংসতা ও সামাজিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক বিভেদকে।
পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রযুক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিকাশ সংবাদমাধ্যমকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। যে কেউ চাইলে যেকোনো তথ্যকে প্রায় বিনা খরচে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারেন। আধুনিক প্রযুক্তি এমন সুযোগ হাতে এনে দিলেও এ পরিস্থিতি সমাজকে এক রকম পিছিয়ে দিয়েছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দুনিয়ায় মানুষের মুখে মুখে গুজব, মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। এরপর উনিশ শতকের শুরু থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগে আত্মপ্রকাশ করে বেশকিছু সংবাদপত্র।
এগুলোর মধ্যে লন্ডনের দ্য টাইমস যাত্রা করে ১৭৮৫ সালে, দ্য গার্ডিয়ান ১৮২১, দি ইকোনমিস্ট ১৮৪৩, দ্য স্ট্রেইটস টাইমস ১৮৪৫, নিউইর্ক টাইমস ১৮৫১, দ্য হিন্দু ১৮৭৮, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস ১৮৮৮, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ১৮৮৯ সালে এমন আরো অনেক নাম পাওয়া যাবে। এসব সংবাদপত্র পেশাদার সাংবাদিকতার মাধ্যমে নির্ভুল, প্রামাণ্য সংবাদ প্রকাশ শুরু করে। সংবাদপত্রগুলো শতবর্ষের বেশি সময় ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। ইতিহাসের অনেক ঝড়-ঝাপটা, মালিকানা বদলের মতো ঘটনা ঘটার পরও এসব পত্রিকার টিকে থাকা ভালো সংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতাকে প্রমাণ করে। ডিজিটাল যুগে সেই অতীত পরিস্থিতিই যেন আবার হাজির হয়েছে। এখন স্বার্থান্বেষী মহল আরো দ্রুতগতিতে গুজব, মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে দিতে পারছে। তাই পেশাদার সাংবাদিকতার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি, বরং যুগের চাহিদায় তা আরো বেড়েছে।
ডিজিটাল যুগে যত কিছুই বদলে যাক না কেন সাংবাদিকতার মৌলিক রীতি বদলে যায়নি। সাংবাদিককে এখনো অনুসন্ধান এবং পাঠকের সামনে অজানা সত্য হাজির করতে হয়। ঘটনার প্রেক্ষাপট, ব্যাখ্যা, নানামুখী বিশ্লেষণ, প্রভাব, বিশেষজ্ঞ মতামতও সাংবাদিক তুলে আনেন। আর এসবের মাধ্যমে একজন পাঠক তার দেশ, এমনকি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল হন এবং সক্রিয় নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে পারেন। সংবাদ প্রকাশের যত ধরনের নতুন মাধ্যমই জনপ্রিয় হোক না কেন অনুসন্ধানী ও উত্কৃষ্ট সাংবাদিকের কাজ সেই পুরনো দিনের মতোই থাকছে। তাকে পেশাদার সাংবাদিকতা করেই পাঠকের কাছে প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের সমাজ-রাষ্ট্রের বিকাশে সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় প্রামাণ্য সংবাদ দরকারি উপাদান। জনগণের মতামত দেয়ার জন্য প্রয়োজন পড়ে প্রামাণ্য-প্রাসঙ্গিক সংবাদের, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের। এমন সংবাদ তারা টাকা খরচ করে পড়তে আগ্রহী হন। এভাবে সংবাদপত্র অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়। পাঠকের আস্থা থাকলে বিজ্ঞাপনদাতারা আগ্রহী হন সেই সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতে।
সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা না হলে সমাজে ভুয়া খবর, গুজব বাড়ে। এ পরিস্থিতি গণতন্ত্রের টিকে থাকা ও বিকাশের জন্য প্রতিকূল। ডিজিটাল যুগে ভুয়া খবরের বিস্তার এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরের প্রচার দেশে দেশে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ক্ষয়ে ভূমিকা রাখছে। তাই স্বাধীন ও পেশাদার সাংবাদিকতার গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর অভাবে নাগরিকদের মধ্যে ভুয়া বা উদ্দেশ্যমূলক খবর, গুজবে বিশ্বাস করার প্রবণতা বাড়বে। এ রকম পরিস্থিতি কোনো দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা, সুশাসন, নাগরিক সমাজ, বেসরকারি উদ্যোগ—সবকিছুকেই বিপদে ফেলে।
কাগজে মুদ্রিত অক্ষরে প্রকাশিত সংবাদ তাই এ যুগেও প্রাসঙ্গিক এবং আগের চেয়ে মূল্যবান। ডিজিটাল মাধ্যমের মতো চাইলে এ সংবাদ সরিয়ে নেয়া বা পরিবর্তন করা যায় না। দায়িত্ব নিয়ে, পেশাদারত্বের মাধ্যমে ছাপা সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ করতে হয়। এখানে তাই সৎ অনুসন্ধান ও সম্পাদনা ছাড়া খবর প্রকাশ করা কঠিন। সে রকম হলে পত্রিকা পাঠক ও বিজ্ঞাপনদাতার আস্থা হারাবে। পেশাদার সাংবাদিকতাই তার টিকে থাকার পুঁজি।
এ যুগের চ্যালেঞ্জ তাই ভালো সাংবাদিকতার। জরুরি, নির্ভুল ও যুক্তিযুক্ত সংবাদ পাঠকের কাছে এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে, যা তিনি ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য দরকারি বিবেচনা করবেন। নতুন করে যুদ্ধ, দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার উত্থান, প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব মানুষকে নির্ভরযোগ্য খবরের প্রতি মনোযোগী করে তুলছে। সুশাসনের প্রত্যাশা থেকে মানুষ সমাজ-রাষ্ট্রে ঘটে চলা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর জানতে চায়। গবেষক-অ্যাক্টিভিস্টরা সংবাদপত্র থেকে সংগ্রহ করেন দরকারি তথ্য। বিশ্বজুড়েই গণমাধ্যমের বড় অংশ এখন চটকদার ও অদরকারী সংবাদে সয়লাব। কিন্তু নাগরিকদের মধ্যে অনেকে এখনো বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে নির্ভরযোগ্য ও ঘটনার আড়ালে থাকা সত্য জানতে আগ্রহী। তাই সাংবাদিককে অনুসন্ধান, তথ্য ও সূত্র যাচাইপূর্বক খবরকে নিখুঁত ও আকর্ষণীয় চেহারায় পাঠকের সামনে পত্রিকার পাতায় হাজির করতে হবে। এমন সংবাদের জন্য পাঠক ছাপা সংবাদপত্র কিনবেন। আগ্রহী হবেন বিজ্ঞাপনদাতারাও। ডিজিটাল যুগের সংকটের মধ্যেও নির্ভরযোগ্য সংবাদ ও তথ্যের প্রয়োজনীয়তা কখনো ফুরাবে না। আর তা নিশ্চিত হতে পারে কেবল সৎ, মেধানির্ভর ও সাহসী সাংবাদিকতার মাধ্যমে। সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে ভালো সাংবাদিকতার ওপরই।
আজ বণিক বার্তা ১১ বছর পূর্ণ করে এক যুগে পদার্পণ করেছে। আমাদের যাত্রা এবার যুগপূর্তির দিকে যাত্রার শুরুতে আমাদের আশা ছিল রাজনীতি, অপরাধ, নিত্যদিনের নানা ঘটনার বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি, নীতি বিশ্লেষণের মতো বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে একটি দৈনিক পত্রিকাকে সাজানো। একই সঙ্গে আমরা পাঠকের জন্য নির্ভুল তথ্য ও প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ নিশ্চিত করতে চেয়েছি। নানা ধরনের প্রতিকূলতা, চাপ মোকাবেলা করে বণিক বার্তা পাঠকের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। সুসাংবাদিকতার মাধ্যমেই বণিক বার্তা বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। পেশাদারত্বের মাধ্যমে যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পাঠকের আস্থার প্রতিদান দিতেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এক যুগে পদার্পণ করার এই দিনে বণিক বার্তার সব পাঠক, লেখক, এজেন্ট, হকার ও শুভানুধ্যায়ীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনাদের আস্থা, ভালোবাসা ও সহযোগিতা না থাকলে আমাদের এ অর্জন সম্ভব হতো না। সুত্রঃ বণিক বার্তা

নিউজ ডেস্ক, জাগো২৪.নেট 























