শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নদীর পেটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঝড়ে পড়ছে শিক্ষার্থী

নদীবেষ্টিত গাইবান্ধার বুকচিরে বয়ে গেছে যমুনা-বহ্মপুত্রসহ বেশ কিছু নদ-নদী। এরই মাঝে জেগেছে দেড় শতাধিক চরাঞ্চল। এখনকার অধিকাংশ মানুষ নদী ভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে বসবাস করতে হয়। আর ওইসব নদীর অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে করে প্রতি বছরেই অসংখ্যা শিশু শিক্ষা ঝড়ে পড়ছে বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফুলছড়ি উপজেলার মধ্য গলনা চরের পঞ্চম শ্রেণির প্রাক্তন শিক্ষার্থী মানিক মিয়া। পড়ালেখা করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তার। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর কড়াল গ্রাসে যেমন তিন বার ভেঙে গেছে স্কুল, তেমনি তিন বার ভিটেমাটি হারিয়ে আজ নিঃস্ব তার পরিবার। এক সময় ওই চরে আধিপত্য করা মানিকের পরিবার বর্তমানে ব্যাঙ্কার চরে বসবাস করছে অন্যের জমিতে। আর গত কয়েক বছরে একাধিকবার নদীতে শুধু ঘরবাড়ি, আবাদী জমি, গৃহপালিত পশু-পাখি, স্কুল, ক্লিনিকই নয়, তার সাথে ভেসে গেছে শিশু মানিকের স্বপ্ন।

আর এই গল্প মানিকের একার নয়, চরের এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা পড়ালেখার ইচ্ছে থাকলেও দারিদ্রতার জন্য স্কুলে ফিরতে পারছে না। এমনই এক শিক্ষার্থী রতন মিয়া। বাড়ি কুন্দেরপাড়া চরে। কয়েক বছর আগে নদীতে ভেসে গেছে ঘর-বাড়িসহ তাদের সর্বস্ব। কয়েক দিন পর বন্যার পানি নেমে গেছে ঠিকই, কিন্তু ভেঙে যাওয়া কোনো কিছুই আর ফেরত আসে নি। অসুস্থ বাবা-মাকে রেখে পাড়ি জমিয়েছে সুদূর ঢাকায়। এখন একটা গ্যারেজে কাজ করছে সে। এক সময় ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করা ছেলেটি শিশুশ্রমের শিকার হয়েছে। অথচ কারও কিছু করার নেই। প্রকতৃতির কাছে সবাই যেনো জিম্মি। প্রতি বছরই নতুন বই-খাতা, কলম-পেন্সিল, পোশাকের সাথে নতুন স্বপ্ন বুনে গাইবান্ধা জেলার ১৬৫টি চরের শিশুরা। কিন্তু প্রতি বারই তাদের উদ্যোমী চেতনাকে হতাশায় পরিণত করে বন্যা, নদী ভাঙন, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ। ফলে দূর্যোগ শেষে অভাব-অনটন, দারিদ্রতার সাথে প্রনিনিয়ত লড়াই করতে করতে চাপা পড়ে তাদের শিক্ষার অধিকার। মনে লালন করা সুপ্ত ইচ্ছেকে চাপা দিয়ে রতনের মতো অনেক শিশুকে যুক্ত হতে হচ্ছে খেতে-খামার, গ্যারেজে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ কোন কাজে। কেওবা জীবন-জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান ঢাকা শহরে।

নদী ভাঙনের কারণে শিশুদের ঝরে যাওয়ার সাথে সাথে এমনইভাবে বাড়ছে শিশুশ্রমও। যে বয়সে এসব শিশুর পড়ালেখা আর খেলাধুলা করার কথা, সে বয়সে নিজেদের সাজানো স্বপ্ন বিসর্জন দিচ্ছে তারা।

আবার অনেক শিশুর অভিযোগ, বন্যায় তাদের স্কুল অনেক দিন বন্ধ থাকে। এতে তাদের পড়ালেখা ব্যাহত হয়। অনেক সময় বন্যা নেমে যাওয়ার পরও পড়ালেখা হয় না। ফলে এক শ্রেণিতে দুইবার থাকতে হয়।  যা তাদের ভালো লাগে না। বিপর্যয় কাটিয়ে এসব শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হতে চাইলেও বন্যা বা নদী ভাঙনে বিলীন হওয়া বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ দেরিতে হওয়ায় বিমুখ হয়ে পড়েন অনেকে।

এদিকে, গাইবান্ধা সদর উপজেলা ও ফুলছড়ি উপজেলার বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা যায়, নদী ভাঙনে বিদ্যালয় বিলীন হয়ে যাওয়ায় তাদের পাঠদান চলছে ত্রিপল টানিয়ে খোলা আকাশের নিচে। আবার, বিদ্যালয়গুলোতে দেখা মেলে না নির্দিষ্ট সময় অবধি শিক্ষকদের উপস্থিতি। ফুলছড়ির পুরাতন হেড কোয়ার্টার এলাকার নৌকার ঘাট থেকে ব্যাঙ্কার চরে পৌঁছাতে লাগে ১ ঘন্টা। এই ঘন্টায় চর্তুদিকে শুধু নদী ভাঙন ও বন্যা পরবর্তী দগদগা ঘা নজরে আসে। যমুনা নদীর মাঝে এক চিলতে এই চরটিতে সব হারিয়ে বাসা বেধেঁছে কয়েকশ পরিবার।  ওই বাড়িগুলো ঘুরে দেখা যায়, মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ জন শিশু যাচ্ছে স্কুল-মাদরাসায়। যা খুবই হতাশাজনক। অভিভাবকদের সাথে কথা হলে ঘুরে ফিরে এক কথা, পেট চলে না, বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে কি করবে। তার থেকে পরের হোটেলে কাজ করলেও দু টাকা সংসারে আসবে।

গলনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক খাদিজা খাতুন জাগো২৪.নেট-কে বলেন, নদীভাঙনের কারণে এখন পর্যন্ত ৪ বার বিদ্যালয়টি বিলীন হয়েছে। বার বার পুণঃনির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২ শতাধিক শিক্ষার্থী থাকলেও এখন এর সংখ্যা দাড়িয়েছে ৬০ জনে। আবার এই শিক্ষার্থীদেরও বাসায় গিয়ে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। বার বার অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। তবে, সৃষ্ট এ পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম নদী ভাঙনরোধে স্থায়ীভাবে পুর্ণবাসন করার তাগিদ দেন।

এ বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউপি সদস্য মো. হাছান আলী জাগো২৪.নেট-কে বলেন, এসময় নিজেই নিঃস্ব হয়ে বড় ভাইয়ের জায়গায় আবাসন গড়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। এমতাবস্থায় চরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে অতিরিক্ত অনুদানসহ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই জনপ্রতিনিধি।

গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, জেলার সদর উপজেলা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও সাঘাটা উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১১৬ টি। অন্যদিকে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১২টি। এসবের মধ্যে চরাঞ্চলেও রয়েছে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

জনপ্রিয়

নদীর পেটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঝড়ে পড়ছে শিক্ষার্থী

প্রকাশের সময়: ০৪:৪১:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৩

নদীবেষ্টিত গাইবান্ধার বুকচিরে বয়ে গেছে যমুনা-বহ্মপুত্রসহ বেশ কিছু নদ-নদী। এরই মাঝে জেগেছে দেড় শতাধিক চরাঞ্চল। এখনকার অধিকাংশ মানুষ নদী ভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে বসবাস করতে হয়। আর ওইসব নদীর অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে করে প্রতি বছরেই অসংখ্যা শিশু শিক্ষা ঝড়ে পড়ছে বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফুলছড়ি উপজেলার মধ্য গলনা চরের পঞ্চম শ্রেণির প্রাক্তন শিক্ষার্থী মানিক মিয়া। পড়ালেখা করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তার। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর কড়াল গ্রাসে যেমন তিন বার ভেঙে গেছে স্কুল, তেমনি তিন বার ভিটেমাটি হারিয়ে আজ নিঃস্ব তার পরিবার। এক সময় ওই চরে আধিপত্য করা মানিকের পরিবার বর্তমানে ব্যাঙ্কার চরে বসবাস করছে অন্যের জমিতে। আর গত কয়েক বছরে একাধিকবার নদীতে শুধু ঘরবাড়ি, আবাদী জমি, গৃহপালিত পশু-পাখি, স্কুল, ক্লিনিকই নয়, তার সাথে ভেসে গেছে শিশু মানিকের স্বপ্ন।

আর এই গল্প মানিকের একার নয়, চরের এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা পড়ালেখার ইচ্ছে থাকলেও দারিদ্রতার জন্য স্কুলে ফিরতে পারছে না। এমনই এক শিক্ষার্থী রতন মিয়া। বাড়ি কুন্দেরপাড়া চরে। কয়েক বছর আগে নদীতে ভেসে গেছে ঘর-বাড়িসহ তাদের সর্বস্ব। কয়েক দিন পর বন্যার পানি নেমে গেছে ঠিকই, কিন্তু ভেঙে যাওয়া কোনো কিছুই আর ফেরত আসে নি। অসুস্থ বাবা-মাকে রেখে পাড়ি জমিয়েছে সুদূর ঢাকায়। এখন একটা গ্যারেজে কাজ করছে সে। এক সময় ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করা ছেলেটি শিশুশ্রমের শিকার হয়েছে। অথচ কারও কিছু করার নেই। প্রকতৃতির কাছে সবাই যেনো জিম্মি। প্রতি বছরই নতুন বই-খাতা, কলম-পেন্সিল, পোশাকের সাথে নতুন স্বপ্ন বুনে গাইবান্ধা জেলার ১৬৫টি চরের শিশুরা। কিন্তু প্রতি বারই তাদের উদ্যোমী চেতনাকে হতাশায় পরিণত করে বন্যা, নদী ভাঙন, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ। ফলে দূর্যোগ শেষে অভাব-অনটন, দারিদ্রতার সাথে প্রনিনিয়ত লড়াই করতে করতে চাপা পড়ে তাদের শিক্ষার অধিকার। মনে লালন করা সুপ্ত ইচ্ছেকে চাপা দিয়ে রতনের মতো অনেক শিশুকে যুক্ত হতে হচ্ছে খেতে-খামার, গ্যারেজে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ কোন কাজে। কেওবা জীবন-জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান ঢাকা শহরে।

নদী ভাঙনের কারণে শিশুদের ঝরে যাওয়ার সাথে সাথে এমনইভাবে বাড়ছে শিশুশ্রমও। যে বয়সে এসব শিশুর পড়ালেখা আর খেলাধুলা করার কথা, সে বয়সে নিজেদের সাজানো স্বপ্ন বিসর্জন দিচ্ছে তারা।

আবার অনেক শিশুর অভিযোগ, বন্যায় তাদের স্কুল অনেক দিন বন্ধ থাকে। এতে তাদের পড়ালেখা ব্যাহত হয়। অনেক সময় বন্যা নেমে যাওয়ার পরও পড়ালেখা হয় না। ফলে এক শ্রেণিতে দুইবার থাকতে হয়।  যা তাদের ভালো লাগে না। বিপর্যয় কাটিয়ে এসব শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হতে চাইলেও বন্যা বা নদী ভাঙনে বিলীন হওয়া বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ দেরিতে হওয়ায় বিমুখ হয়ে পড়েন অনেকে।

এদিকে, গাইবান্ধা সদর উপজেলা ও ফুলছড়ি উপজেলার বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা যায়, নদী ভাঙনে বিদ্যালয় বিলীন হয়ে যাওয়ায় তাদের পাঠদান চলছে ত্রিপল টানিয়ে খোলা আকাশের নিচে। আবার, বিদ্যালয়গুলোতে দেখা মেলে না নির্দিষ্ট সময় অবধি শিক্ষকদের উপস্থিতি। ফুলছড়ির পুরাতন হেড কোয়ার্টার এলাকার নৌকার ঘাট থেকে ব্যাঙ্কার চরে পৌঁছাতে লাগে ১ ঘন্টা। এই ঘন্টায় চর্তুদিকে শুধু নদী ভাঙন ও বন্যা পরবর্তী দগদগা ঘা নজরে আসে। যমুনা নদীর মাঝে এক চিলতে এই চরটিতে সব হারিয়ে বাসা বেধেঁছে কয়েকশ পরিবার।  ওই বাড়িগুলো ঘুরে দেখা যায়, মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ জন শিশু যাচ্ছে স্কুল-মাদরাসায়। যা খুবই হতাশাজনক। অভিভাবকদের সাথে কথা হলে ঘুরে ফিরে এক কথা, পেট চলে না, বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে কি করবে। তার থেকে পরের হোটেলে কাজ করলেও দু টাকা সংসারে আসবে।

গলনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক খাদিজা খাতুন জাগো২৪.নেট-কে বলেন, নদীভাঙনের কারণে এখন পর্যন্ত ৪ বার বিদ্যালয়টি বিলীন হয়েছে। বার বার পুণঃনির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২ শতাধিক শিক্ষার্থী থাকলেও এখন এর সংখ্যা দাড়িয়েছে ৬০ জনে। আবার এই শিক্ষার্থীদেরও বাসায় গিয়ে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। বার বার অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। তবে, সৃষ্ট এ পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম নদী ভাঙনরোধে স্থায়ীভাবে পুর্ণবাসন করার তাগিদ দেন।

এ বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউপি সদস্য মো. হাছান আলী জাগো২৪.নেট-কে বলেন, এসময় নিজেই নিঃস্ব হয়ে বড় ভাইয়ের জায়গায় আবাসন গড়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। এমতাবস্থায় চরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে অতিরিক্ত অনুদানসহ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই জনপ্রতিনিধি।

গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, জেলার সদর উপজেলা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও সাঘাটা উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১১৬ টি। অন্যদিকে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১২টি। এসবের মধ্যে চরাঞ্চলেও রয়েছে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।