মানব সভ্যতার শুরু থেকে যত উন্নতি-অগ্রগতি সবই নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল
আফসানা আক্তার মিমি: ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর ‘নারী’ কবিতার লাইনগুলো আজও চিরভাস্বর। তবে, যে চেতনা জাগ্রত আর পরিবর্তনের জন্য এই উক্তি সাজিয়েছিলেন কবি, তা এখনও পৃথিবী সৃষ্টির আদি পর্যায়ের প্রথম দিনের মতোই। মানব সভ্যতার শুরু থেকে যত উন্নতি-অগ্রগতি সবই নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। কিন্তু এ সত্য মানতে নারাজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। ফলশ্রুতিতে যুগ যুগ ধরে বি ত, অবহেলিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছেন নারীরা। সম্ভব হয় নি বৈষম্য দূরীকরণ। পরিবার থেকে শুরু করে কোনো ক্ষেত্রেই নেই নারীদের সঠিক মূল্যায়ন। এমনকি নেই কোনো বাক স্বাধীনতা।
তবে, কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে নারীদের অগ্রযাত্রার পথ সুগম হয়েছে। আদিকালে একজন নারী ঘর থেকে বেরোনোর অনুমতি পেতো না। এখন সংসারের পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন পড়া-লেখা; করছেন চাকরিও। পুরুষদের থেকে অনেকক্ষেত্রে এখন নারীরা এগিয়ে থাকলেও বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই। সভ্য সমাজে এসব বৈষম্য তেমন নজরে না আসলেও গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানের শ্রমজীবী নারীদের সাথে হরহামেশাই ঘটছে এ ঘটনা।
‘এ্যাঙ্কা করি ধানের কাম করবা নাগছি, একনা বসপারও কল পাই না। বেয়ানকা থ্যাকি বেলা যতক্ষণ না পচ্ছে ততক্ষণ কাম করি নেয়, তাও ট্যাকা দেয় কম। হামাঘরের সাতোত কাম করা ব্যাডাগুলা বেশি করি ট্যাকা পায়, এগলা কোনো কতা, আপনি কন’- এভাবে নিজের মনের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন বল্লমঝাড় ইউনিয়নের দিনমজুর ছমিলা বেগম। আমন ও ইরি-দুই মৌসুমে ধান কাঁটা, মাড়াই, সিদ্ধ-শুকান করার কাজ করেন তিনি। পুরুষদের মতোই সকাল-সন্ধ্যা সব কাজ করলেও দিনশেষে মেলে অর্ধেক মজুরি।
তার সাথে কাজ করা সিমলা বলেন, ‘আঙ্গোরে সাতে মেলা কামটা এরা ভালা করে না, ট্যাকাও কম দেয়, আবার কতায় কতায় ছাঁটাই করারও হুমকি দেয়। একবার মন চায় সব ছাড়িছুড়ি ব্যাইত যাই, কিন্তু প্রতিবন্ধি পোলাডার কথা মনে হলে আর পারি না।
কৃষি, গার্মেন্টস শিল্পসহ নির্মাণ খাতে নারীদের অবদান বেশি হলেও প্রান্তিক পর্যায়ে বরাবরই বৈষম্যের শিকার এসব খেটে খাওয়া নারীরা। শুধু ধান কাটাই-মাড়াই নয়, বিভিন্ন হোটেল-রেষ্টুরেন্টে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করা রন্ধন নারী কারিগরদের সাথেও। এ ঘটনা ঘটছে যুগের যুগের পর যুগ। অনেক ক্ষেত্রেই তারা পাচ্ছেন না সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি। রান্না, সবজি কাটা, থালা-বাসন পরিষ্কারসক বিভিন্ন কাজের জন্য তাদের থাকতে হয় ভোর থেকে রাত পর্যন্ত। তারপরও মজুরির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০০-২৫০ টাকা। যা পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪৫০-৫০০ টাকা। এমনই এক নারী শাহানা বেগম। বয়স ৪০ ছুঁই ছুঁই। ৫ বছর আগে স্বামী হারানো এই নারীর পেটই চলে বিভিন্ন রেস্তোরায় কাজ করে। কিন্তু একদিনও তার পুরুষ সহকর্মীর সমান মজুরি না পেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। এছাড়া শহরের বিভিন্ন টেইলার্স ঘুরেও দেখা মেলে একই চিত্র। এমতাবস্থায় ন্যায্য মূল্য ও নিজেদের অধিকারের জন্য আওয়াজ তোলায় অনেককে কাজ হারাতে হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
এক পুরুষ দিনমজুরের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘নারীরাও আমাদের সমান কাজ করে। কিন্তু ওদের মজুরি কম দেয়। আমরাই করি পেটের দায়ে কাজ, ওদের জন্য কথা বলতে গেলে নিজেদের কাজ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। এজন্য চুপ থাকি। কিন্তু এটা ঠিক হচ্ছে না’।
নারীদের সাথে মজুরি বৈষম্যের কারণ জানতে চাইলে এড়িয়ে যান মালিক কর্তৃপক্ষ। আবার অনেকে শোনান আশার বাণী। তবে, এ সমস্যা কতোটা নিরসন সম্ভব এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকে। এজন্য নিজেদের অধিকার আদায়ে নারীদেরই আওয়াজ তোলার উপর গুরুত্বারোপ করেন মানবাধিকারকর্মী অঞ্জলী রানী দেবী। বলেন, এক এক করে যখন সবাই প্রতিবাদ করবে, তখনই প্রান্তিক পর্যায়ে শ্রমজীবী নারীদের মজুরি বৈষম্য দূর হবে। আমরা সব সময় নারীদের এ বিষয়ে কথা বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি। কোনো কিছুই একদিনে পরিবর্তন সম্ভব না। তবে, আমরা আশাবাদী একদিন নজরুলের সাম্যবাদী সমাজ গড়া সম্ভব হবে।
গাইবান্ধা চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মকছুদার রহমান শাহান জাগো২৪.নেট-কে বলেন, দেশের অন্যান্য খাতে এই মজুরি বৈষম্য কম। তবে, শ্রমজীবী নারীরা প্রতিনিয়তই বেতন কম পাচ্ছেন। এ বিষয়ে আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি। বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সভা, সেমিনারে বারংবার এ বিষয়ে প্রস্তাব ও দাবি উত্থাপন করা হয়। দ্রæতই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন নীতিনির্ধারকমহল। তবে, যুগ যুগ ধরে চলমান এই বৈষম্যের চাকা ঠিক কবে নাগাদ বিলুপ্ত হবে এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।
বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক নারী। মজুরির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ নানা সামাজিক বৈষম্য ও ব নার শিকার হচ্ছেন তারা। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি নারীরাও পাচ্ছেন না শ্রমের ন্যায্য মূল্যায়ন।
আফসানা আক্তার মিমি, লাইফস্টাইল করেসপন্ডেন্ট, জাগো২৪,নেট 























