দেহের অর্ধেক অংশ হারিয়ে পঙ্গুত্ব জীবন-যাপন করছেন দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার কুন্দন গ্রামের মোজাম্মেল হক (৫৭)। শরীরের দুটি পা ও শ্রবণশক্তি হারিয়েও, হারায়নি মনোবল। অন্যের কাঁধের বোঝা না হয়ে, মনের জোর আর দেহের অবশিষ্ট হাত দিয়ে কর্ম করে আজও সংসারের ঘানি টানছেন তিনি।
শনিবার (১৯ জুন) বিকেলে উপজেলার কুন্দন গ্রামে গিয়ে দেখে যায়, বাজারের একটি ছোট দোকানে কিছু হাতিয়ার-পাতি নিয়ে দুটি হাতের উপর ভর করে সাইকেল আর ভ্যান মেরামত করছেন মোজাম্মেল হক। কোমড়ের নিচের অংশ নেই তার, মোটা পলিথিনের কাগজ দ্বারা নিচের অংশটি বাঁধা। হাতের উপর ভর করে ভ্যান, রিকশা আর সাইকেলের কাছে যাচ্ছেন। আর শক্ত হাত দিয়ে গাড়িগুলোর চাকা খুলছেন এবং মেরামত করে দিচ্ছেন। ভ্যান, রিকশা আর সাইকেলের সকল মেরামতের কাজ করেন তিনি। সপ্তাহে দুই দিন এখানে হাট বার, হাটের দিন বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসে লোকজন এই হাটে। হাটের দিন মোজাম্মেল হকের দোকানে একটু ভিড় হয় এবং কামাইও হয় একটু বেশি। অন্যদিন কাজের চাপ অনেকটা কম হয়। সারাদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা উপার্জন হয়, তাতে কোন রকম চলে তার সংসার জীবন।
প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর আগে, মোজাম্মেল হকের ডান পায়ের একটি আঙ্গুলে ঘা হয়। আর সেই ঘা জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায় তারা। বিভিন্ন চিকিৎসার পর ডাক্তার বলে তার আঙ্গুলটি কেটে ফেলতে হবে। আঙ্গুলটি কাটার পর, আবারও পায়ের পাতা পর্যন্ত কাটতে হবে। কিছু দিন পর ঐস্থানে আবারও পচন ধরে। এবার কাটতে হবে পায়ের অর্ধেক অংশ। অর্ধেক টাকার পরও রেহায় পায়নি তিনি, সেই স্থানে পচন ধরে। এবার ডাক্তার বলেন উরুর উপরের অংশ পর্যন্ত কেটে ফেলতে হবে। এবার উপরের অংশ কেটে মোজাম্মেল হক ছোট আর প্রতিবন্ধী মানুষ হয়ে গেলেন। তবে তাতেও শেষ হয়নি, পরে হাতের একটি আঙ্গুল এবং গলায় অপারেশনে তার কানের শ্রবণশক্তি একেবারে হারিয়ে যায়। চলার মতো শারীরিক কোন সম্বল নেই তার। একেবারে থমকে গেলো তার জীবনের চলার গতি।
চিকিৎসাপাতি করে সম্পদের বাঁকি ছিলো শুধু ভিটে-বাড়ি। তাও সেই সব ছেলে-মেয়েদের দিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন ছেলে-মেয়েদের বাড়ির পাশে একটি কুঁড়ে ঘর বানিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করে আসছেন তিনি। তবে এই ঘরটি এখন নড়বড়ে হয়ে গেছে, ঝড় আর বৃষ্টিতে তা কখন যেন ভেঙে পড়ে।
এক সময় গ্রামবাসী এই মোজাম্মেল হককে “মেইল” বলে ডাকতো। কেন না তার চলাফেরা ছিলো মেইল গাড়ির মতো। তার দেহে ছিলো দ্বৈতের মতো আর টগবগিয়ে তেঁজি ঘোড়ার মতো। নিজের কাজ সহ অন্যদের কাজ করে দিতো দ্রুত। তাই তাকে সবাই মেইল বলে ডাকতেন।
কিন্তু মেইল গাড়ির মতো দেহ না থাকলেও, মনটা এখনও রয়ে গেছে মেইল গাড়ির মতো। তাই তো তিনি শরীরের অর্ধেক হারিয়েও, মানুষের বোঝা হননি তিনি। হাতের আর মনের জোরে নিজে খেটে চলছেন। তার দোকানে রয়েছে শুধু ভ্যান, রিকশা আর সাইকেল মেরামতের যন্ত্রপাতি। কিন্তু নেই কোন ভ্যান রিকশা কিংবা সাইকেলের যন্ত্রাংশ। যদি কিছু যন্ত্রাংশ থাকতো তাহলে আর ক্রেতারা আসতো এবং তার কাজের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতো। তাতে উপার্জনও বেশি হতো।
ভ্যান মেরামত করতে আসা গোলাম রসুল বলেন, উনি খুবি অসহায় মানুষ, দেখে খুব মায়া লাগে। তাই আমি অন্য কোথাও গাড়ি ঠিক করি না। কষ্ট করে হলেও ইনার নিকট নিয়ে এসে ঠিক করে নেয়।
করিম উদ্দিন নামের একজন ভ্যান চালক বলেন, এই মেইল ভাইয়ের পা না থাকলেও তার শরীরে শক্তি অনেক আছে। তার হাতের কাজ খুব মজবুত। অন্য কোথাও কাজ করি না।
একজন স্থানীয় দোকানদার রফিকুল ইসলাম বলেন, মোজাম্মেল হক মেইল ভাই এক সময় তরতাজা মানুষ ছিলেন। পা দুটো হারিয়ে আজ নিঃস্ব। কিন্তু তাও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেনি। জীবনে কামাই করে অনেক কিছু করেছিলেন। তার অসুখে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন এই কাজ করে বউকে নিয়ে কোনমতে চলে।
তবে সরকার এবং কোন দায়াবান মানুষ যদি তাকে একটু আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তাহলে এই অবস্থায় থেকেও সে বাঁকি জীবনটা একটু সুখে থাকতেন।
কথা হয় সেই পঙ্গু মোজাম্মেল হকের সাথে, তিনি বলেন, জীবনে অনেক কিছুই করেছিলাম। আজ আর কিছুই নাই, পায়ের মতো সম্পদ হারিয়ে, আজ আমি পঙ্গু। তবু আমি পঙ্গুত্ব জীবন মেনে নিতে পারিনি। দেহের অবশিষ্ট থাকা দুইটি হাতকে পুঁজি করে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। সারাদিনে এই সাইকেল মেরামত করে যা পাই তাই দিয়ে কোনভাবেই স্ত্রীকে নিয়ে চলছি। যদি কিছু অর্থ পেতাম তাহলে সাইকেল, ভ্যান আর রিকশার জিনিসপাতি কিনতাম। তাহলে আমার দোকানে আরও লোকজন আসতো। তাতে শেষ বেলায় হয়তো একটু সুখের নাগাল পেতাম।
উপজেলার বিনাইল ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম জাগো২৪.নেট-কে জানান, মোজাম্মেল হক আমার ইউনিয়নের লোক, সে একজন কর্মঠো মানুষ ছিলেন। পা দুটো কেটে একেবারে পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেক আগেই তাকে আমি পঙ্গু ভাতার কার্ড করে দিয়েছি এবং আমার পরিষদ থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করবো।
এবিষয়ে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পরিমল সরকার জাগো২৪.নেট-কে জানান, কুন্দন গ্রামের পঙ্গু মোজাম্মেল হকের বিষয় আমি আগেও জেনেছি। তার পঙ্গু ভাতার কার্ডও আছে। তবে এই সব পঙ্গুদের জন্য যদি কোন সরকারি সুযোগ সুবিধা আসে তাহলে অবশ্যই তাকে দেওয়া হবে।
মোসলেম উদ্দিন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, জাগো২৪.নেট. দিনাজপুর 























