শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গণমাধ্যম কি ফিরবে?

  • নিয়ন মতিয়ুল
  • প্রকাশের সময়: ১২:৪৮:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২
  • ১১
জনগণের ‘হাতছাড়া’ হয়ে গেছে গণমাধ্যম। পরিণত হয়েছে রাজনীতি আর পুঁজিবাদের টিস্যুতে। জনস্বার্থ চাপা পড়েছে রাজনৈতিক আর করপোরেট স্বার্থের নিচে। যেসব মেগা তারকার হাতে আজকের সংবাদমাধ্যমের স্টিয়ারিং তাদের মগজ মূলত ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের। আর দৃষ্টিভঙ্গি ষাটের দশকের রাজনৈতিক ফ্যান্টাসিতে ভরপুর। তাদের পোশাক আর বাকপটুতা নানা ঢঙে রঙে-রূপে শুধু ঝলকেই দেয়, চমকেই দেয়; ভেতরের মগজ আর বদলায় না।
মূলত, আজকের ‘গলি থেকে রাজপথ’ অবধি গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপক আর পরিচালকদের সিংহভাগই আশি-নব্বই দশকের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী কিংবা প্রবলমাত্রার সমর্থক। মননে-মগজে তারা সোনালি অতীতেই আত্মপরিচয়-ঠিকানা খোঁজেন। একবিংশ শতকের দু’দশক পেরিয়ে বিশ্ব যখন বড় পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তখনও আমাদের সংবাদব্যবস্থাপকরা সেই ষাট-সত্তর দশকের ফ্যান্টাসিতেই ডুবে আছেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অর্থ তারা যেমন জানেন না, তেমনি জানার প্রয়োজনও বোধ করেন না।
গগণ বিদারী আওয়াজ দিয়ে যেসব সংবাদমাধ্যম প্রতিনিয়ত বিশাল পুঁজির জৌলুস নিয়ে ষাটের দশকের মগজে ভর করে ভূমিষ্ট হচ্ছে চমকের পর চমক দিয়ে সেগুলো কিছুদিন পরেই ফিরছে প্যাভিলিয়নে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে, পুঁজি-জৌলুস হারিয়ে, শঙ্কায় ফেলছে হাজার হাজার সংবাদকর্মীকে। যদিও গণমাধ্যমকে গণশত্রুতে পরিণত করা ষাটের দশকের মগজরা নতুন নতুন প্রকল্প ঠিকই বাগিয়ে নিচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বীহীনতার সুযোগে।
এক সময় ডানপন্থি মগজদের নতজানু চরিত্র ডানধারার সংবাদমাধ্যমকে একেবারেই বিলুপ্তির পথে নিয়ে গেছে। সেই ধারায় বামধারার প্রগতিশীল নায়কেরাও গত কয়েক দশকে স্বার্থপর-মূর্খ-পশ্চাৎমুখী হয়ে ওঠা রাজনীতির প্রবল সেবক হয়ে, পতিতাপুঁজিবাদের এজেন্ট হিসেবে গণমাধ্যমকে একেবারেই ‘গণবিচ্ছিন্ন’ করে ছেড়েছে। একইসঙ্গে সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা আর স্বার্থরক্ষার ছদ্মাবরণে রাজনীতির সেবক বানাতে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার অ্যাসোসিয়েশন।
সংবাদকর্মীদের সেই অ্যাসোসিয়েশনগুলো যতই শক্তিশাল হয়ে উঠেছে, ততই ভেঙে পড়েছে সংবাদমাধ্যমের মৌল কাঠামো। যাতে সবচেয়ে বেশি বাতাস দিয়ে গেছেন জনগণের অর্থে পরিচালিত সংবাদমাধ্যমগুলোর মহাসুখে থাকা কর্মীরা। যারা জনগণের অর্থে নিজেদের সুখভোগ বাড়িয়ে সরকারের মুখপাত্র হিসেবে জনস্বার্থের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন প্রতিনিয়ত। জনগণের মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারেননি।
অবশ্য মননে-মগজে রাজনীতির প্রবল সেবক সেসব গণমাধ্যমকর্মী সময়ের যুদ্ধে নতজানু হয়ে এখন রাজনৈতিক সুপারস্টারদের কাছে পরিত্যক্ত হচ্ছেন। এতদিন ধরে যাদের বা যে রাজনীতির সেবা করে গেছেন সেই রাজনীতিই ‘বৃষ্টির পরের ছাতা’ হিসেবে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে ডাস্টবিনে। এমন পরিস্থিতিতে ‘গণবিচ্ছিন্ন’ গণমাধ্যমের আশি-নব্বই দশকের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক তারকা হাজার হাজার সংবাদকর্মীদের শঙ্কায় ফেলে অবসরের চিন্তা করছেন।
গণমাধ্যমের এই বিপর্যয়কালে বিশ্বব্যাপী নতুন এক ধারা তৈরি হচ্ছে। পুঁজির জন্য বিশেষ গোষ্ঠি কিংবা রাজনীতির কাছে জিম্মি না হয়ে সরাসরি জনগণের অর্থেই পরিচালিত হতে চায় গণমাধ্যম। যে গণমাধ্যম জনগণের হয়ে, জনস্বার্থেই কথা বলবে। জনগণের চাওয়াতেই পরিচালিত হবে নতুন সেই ধারা। বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যেই সেই ধারার যাত্রা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। একবিংশ শতকের মেধাবী ডানপিটে প্রজন্মের হাত ধরে গণমাধ্যমের সেই ধারার জন্য এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
(গণমাধ্যম ভাবনা: নিয়ন মতিয়ুল। ২৪ জুলাই, ২০২২, এলিফেন্ট রোড, ঢাকা)

গণমাধ্যম কি ফিরবে?

প্রকাশের সময়: ১২:৪৮:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২
জনগণের ‘হাতছাড়া’ হয়ে গেছে গণমাধ্যম। পরিণত হয়েছে রাজনীতি আর পুঁজিবাদের টিস্যুতে। জনস্বার্থ চাপা পড়েছে রাজনৈতিক আর করপোরেট স্বার্থের নিচে। যেসব মেগা তারকার হাতে আজকের সংবাদমাধ্যমের স্টিয়ারিং তাদের মগজ মূলত ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের। আর দৃষ্টিভঙ্গি ষাটের দশকের রাজনৈতিক ফ্যান্টাসিতে ভরপুর। তাদের পোশাক আর বাকপটুতা নানা ঢঙে রঙে-রূপে শুধু ঝলকেই দেয়, চমকেই দেয়; ভেতরের মগজ আর বদলায় না।
মূলত, আজকের ‘গলি থেকে রাজপথ’ অবধি গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপক আর পরিচালকদের সিংহভাগই আশি-নব্বই দশকের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী কিংবা প্রবলমাত্রার সমর্থক। মননে-মগজে তারা সোনালি অতীতেই আত্মপরিচয়-ঠিকানা খোঁজেন। একবিংশ শতকের দু’দশক পেরিয়ে বিশ্ব যখন বড় পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তখনও আমাদের সংবাদব্যবস্থাপকরা সেই ষাট-সত্তর দশকের ফ্যান্টাসিতেই ডুবে আছেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অর্থ তারা যেমন জানেন না, তেমনি জানার প্রয়োজনও বোধ করেন না।
গগণ বিদারী আওয়াজ দিয়ে যেসব সংবাদমাধ্যম প্রতিনিয়ত বিশাল পুঁজির জৌলুস নিয়ে ষাটের দশকের মগজে ভর করে ভূমিষ্ট হচ্ছে চমকের পর চমক দিয়ে সেগুলো কিছুদিন পরেই ফিরছে প্যাভিলিয়নে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে, পুঁজি-জৌলুস হারিয়ে, শঙ্কায় ফেলছে হাজার হাজার সংবাদকর্মীকে। যদিও গণমাধ্যমকে গণশত্রুতে পরিণত করা ষাটের দশকের মগজরা নতুন নতুন প্রকল্প ঠিকই বাগিয়ে নিচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বীহীনতার সুযোগে।
এক সময় ডানপন্থি মগজদের নতজানু চরিত্র ডানধারার সংবাদমাধ্যমকে একেবারেই বিলুপ্তির পথে নিয়ে গেছে। সেই ধারায় বামধারার প্রগতিশীল নায়কেরাও গত কয়েক দশকে স্বার্থপর-মূর্খ-পশ্চাৎমুখী হয়ে ওঠা রাজনীতির প্রবল সেবক হয়ে, পতিতাপুঁজিবাদের এজেন্ট হিসেবে গণমাধ্যমকে একেবারেই ‘গণবিচ্ছিন্ন’ করে ছেড়েছে। একইসঙ্গে সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা আর স্বার্থরক্ষার ছদ্মাবরণে রাজনীতির সেবক বানাতে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার অ্যাসোসিয়েশন।
সংবাদকর্মীদের সেই অ্যাসোসিয়েশনগুলো যতই শক্তিশাল হয়ে উঠেছে, ততই ভেঙে পড়েছে সংবাদমাধ্যমের মৌল কাঠামো। যাতে সবচেয়ে বেশি বাতাস দিয়ে গেছেন জনগণের অর্থে পরিচালিত সংবাদমাধ্যমগুলোর মহাসুখে থাকা কর্মীরা। যারা জনগণের অর্থে নিজেদের সুখভোগ বাড়িয়ে সরকারের মুখপাত্র হিসেবে জনস্বার্থের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন প্রতিনিয়ত। জনগণের মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারেননি।
অবশ্য মননে-মগজে রাজনীতির প্রবল সেবক সেসব গণমাধ্যমকর্মী সময়ের যুদ্ধে নতজানু হয়ে এখন রাজনৈতিক সুপারস্টারদের কাছে পরিত্যক্ত হচ্ছেন। এতদিন ধরে যাদের বা যে রাজনীতির সেবা করে গেছেন সেই রাজনীতিই ‘বৃষ্টির পরের ছাতা’ হিসেবে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে ডাস্টবিনে। এমন পরিস্থিতিতে ‘গণবিচ্ছিন্ন’ গণমাধ্যমের আশি-নব্বই দশকের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক তারকা হাজার হাজার সংবাদকর্মীদের শঙ্কায় ফেলে অবসরের চিন্তা করছেন।
গণমাধ্যমের এই বিপর্যয়কালে বিশ্বব্যাপী নতুন এক ধারা তৈরি হচ্ছে। পুঁজির জন্য বিশেষ গোষ্ঠি কিংবা রাজনীতির কাছে জিম্মি না হয়ে সরাসরি জনগণের অর্থেই পরিচালিত হতে চায় গণমাধ্যম। যে গণমাধ্যম জনগণের হয়ে, জনস্বার্থেই কথা বলবে। জনগণের চাওয়াতেই পরিচালিত হবে নতুন সেই ধারা। বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যেই সেই ধারার যাত্রা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। একবিংশ শতকের মেধাবী ডানপিটে প্রজন্মের হাত ধরে গণমাধ্যমের সেই ধারার জন্য এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
(গণমাধ্যম ভাবনা: নিয়ন মতিয়ুল। ২৪ জুলাই, ২০২২, এলিফেন্ট রোড, ঢাকা)