বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৮:২১ অপরাহ্ন

জীবন-মরণযুদ্ধে বীরঙ্গনা ফুলমতি

তোফায়েল হোসেন জাকির
  • প্রকাশের সময় : রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩

তোফায়েল হোসেন জাকির:  রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি (৮০)। ১৯৭১ সালে তার বয়স যখন ২৮ বছর, তখন মুক্তিযুদ্ধে উত্তাল ছিল দেশ। এরই মধ্যে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। এই যুদ্ধে দেশ স্বাধীনের ৪৫ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ায় ফুলের মতো হাসি ফুটে ফুলমতির। কিন্তু এই হাসি যেন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বার্ধক্যজনিত কারণে শরীরজুড়ে নানা রোগের বাসা বেঁধেছে। প্রায় ২ বছর ধরে হাসপাতাল আর বাড়ির বিছানায় দিনরাত কাটছে তার। যেন জীবন-মরণযুদ্ধে সময় পার করতে হচ্ছে এই বীরঙ্গনাকে।

এই ফুলমতির বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলা শহরের উত্তরপাড়ায়। তিনি মৃত কুশিরাম সরকার ফসিয়ার স্ত্রী। সম্প্রতি দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। আবার এইদিনই বিকেলে ভর্তি করা হয় সাদুল্লাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখা গেছে তাকে।

জানা যায়, কুশিরাম সরকার ফসিয়া ছিলেন অত্যান্ত একজন গরীব মানুষ। নিজের জায়গা জমি না থাকায় সরকারি খাস জমিতে বসবাস করতেন। এখান থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন তিনি। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এক বিহারির সঙ্গে হঠাৎ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগিরা তার বাড়িতে প্রবেশ করে স্ত্রী রাজকুমারি রবিদাস ফুলমতিকে ঘর থেকে বের করে নানাভাবে নির্যাতন করে। এভাবে পাক হানাদারের হাতে লাঞ্চিত হয় ফুলমতি। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী, ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে ১৯৮৮ সালে কুশিরাম সরকার ফসিয়া মারা গেছেন। এরই মধ্যে ১ ছেলে ও এক মেয়ে মারা যায়। এরপর ফুলমতির জীবনে আরও নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া।

এদিকে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার চেয়েছিলেন। এ নিয়ে সরকারি দপ্তর ও স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে দীর্ঘ ৪৫ বছর লড়াইয়ের পর গত ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ মাসে স্বীকৃতি পেয়েছেন এই বীরাঙ্গনা। এরপরই ফুলের মতো হাসি ফুটে ফুলমতির মুখে। সুস্থ শরীরে বীরদর্পে চলাফেরা করে আসছিলেন তিনি। এরই একপর্যায়ে বয়সের ভারে নুয়ে পরার কারণে অসুখ তার পিছু ছাড়ছে না। গত ২০২১ সালের ৪ জুন মাসে ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে ডান হাত-পা অবস হয়। মন চাইলে আর চলতে পারেন না এদিক-সেদিক। অসুখ-বিসুখ লেগে থাকায় তিনি এখন গৃহবন্দী। দিনরাত যাচ্ছে বিছানায় শুয়ে। আবার কখনো কখনো তাকে নিতে হয় হাসপাতালে। এভাবে দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফুলমতি। তাকে সেবা-যত্নে ছেলে মনিরাজ কুমার সরকারসহ অন্যান্য ছেলে-মেয়ে ও নাতনি তৃষ্ণা রানী দাস সর্বদা নিয়োজিত আছে। তবে অর্থভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা সহায়তার জন্য প্রত্যেক অর্থ বছরে সরকারি বরাদ্দ থাকলেও এ সুবিধা কখনো পায়নি বলে জানায় স্বজনরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বীরাঙ্গনার ৪ ছেলের মধ্যে দুই ছেলে রতন ও নিরঞ্জন দিনমজুর। এক ছেলে সুজন সরকারি দপ্তরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি। আরেক ছেলে মনিরাজ কুমার সরকার ২০১৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। এরপর থেকে একটি সরকারি চাকরির জন্য বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন কিংবা পরীক্ষা দিয়েও তার কপালে জোটেনি সেই কাঙ্খিত চাকরি। তাই বেকার জীবনের অভিশাপ নিয়ে মায়ের সেবা যত্ন করে চলছেন। ইতোমধ্যে চাকরির বয়স শেষে হয়েছে মনিরাজের। এর আগে ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরে স্টোর কিপার পদে আবেদন করলেও সেটির পরীক্ষা এখনো নেওয়া হয়নি।

রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতির ছেলে মনিরাজ কুমার সরকার বলেন, আমার মা কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। তাকে সুস্থ করতে সর্বাত্নকভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আরও উন্নত চিকিৎসার দরকার কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসাসেবা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার পরও চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

বীরঙ্গনা-বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি বলেন, সরকার আমাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছেন। এ জন্য কৃতজ্ঞ। এখন আর শরীর চলছে না। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারি না। প্রসাব-পায়খানা, খাওয়া-বিশ্রাম সবই বিছানায় করতে হয়। তবে আমার ছেলে মনিরাজ কুমার সরকারকে যদি একটি চাকরির সুযোগ দিতো তাহলে চিন্তামুক্ত থাকতাম।

সাদুল্লাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ আজমী বলেন, বার্ধক্যজনিত কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজকুমারী রবিদাস ফুলমতি প্রায়ই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমরা নিয়মিত তার খোঁজ-খবর নিচ্ছি। এ বিষয়ে সাদুল্লাপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. রোকসানা বেগম বলেন, ফুলমতির চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপত্রসহ আমার কাছে আবেদন করলে আমি ফরওয়ার্ড করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে দিব।স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ওষুধ নিতে পারবে।

শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর

© ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | জাগো২৪.নেট

কারিগরি সহায়তায় : শাহরিয়ার হোসাইন