তোফায়েল হোসেন জাকির: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় গড়ে উঠা ঐতিহ্যবাহী হোসিয়ারি শিল্প কারখানাগুলোতে জমে উঠেছে শীতবস্ত্র তৈরি ও তা বিক্রির রমরমা পরিবেশ। শীত যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এ শিল্পের মালিক-শ্রমিকদের ব্যস্ততা। উতোমধ্যে এখানকার উৎপাদিত শীতবস্ত্র ঢাকাসহ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। এতে প্রতিদিন কোটি টাকার বস্ত্র বেচা-কেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর ও নয়ারহাট মার্কেটে দেখা যায়, হোসিয়ারি শিল্পের উৎপাদিত শীতবস্ত্র বেচা-কেনার চিত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর মাড়োয়ারিদের কাছে পাওয়া হস্তচালিত দুটি যন্ত্র দিয়ে শুরু হয় কোচাশহরের হোসিয়ারি শিল্পের যাত্রা। কোচাশহর ইউনিয়নের পেপুলিয়া গ্রামে আব্দুর রহিম নামের এক ব্যক্তির সুতি সুতায় বোনা মোজার মাধ্যমে হোসিয়ারি শিল্পের সূচনার মাধ্যমে তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে। শীতকে ঘিরে এখানে তৈরী হয় সোয়েটার, কার্ডিগান, মোজা, মাফলার, টুপিসহ ১৫০ ধরনের শীতবস্ত্র। আর নয়ারহাট নামের শীতবস্ত্রের এই বাজারের শো-রুমগুলোতে পাওয়া যায় ওইসব পণ্য।
এসব পোশাক তৈরি হয় কোচাশহর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর, শক্তিপুর, পেপুলিয়া-কানাইপাড়া, ধারাইকান্দী, মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের গোপালপুর, শ্রীপতিপুর, পুনতাইড়, জগদীশপুর, কুমিড়াডাঙ্গা, শালমারা ইউনিয়নের কলাকাটা. উলিপুর, দামগাছা, শালমারাসহ বিভিন্ন গ্রামে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দোকানীরা এখানকার প্রধান ক্রেতা। নয়ারহাটের চার শতাধিক দোকান থেকে পাইকারদের হাত ঘুরে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এখানকার ব্যবসায়ীদের আশা এবারের শীত মওসুমে বিক্রি হবে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার শীতবস্ত্র।
স্থানীয়রা জানায়, ব্রিটিশ আমলে গ্রামীণ এ জনপদ পরিচিতি পেয়েছে কুটির শিল্পের এলাকা হিসেবে। তখন কেবল সুতি সুতোয় হস্তচালিত মেশিনে বোনা হাত ও পায়ের মোজা শীতকালে আশপাশের হাট-বাজারগুলোতে বিক্রি করতেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে উন্নত মেশিন ও উতেল সুতা আমদানি সহজ হলে এখানকার উদ্যোক্তারা শুরু করেন মোজার পাশাপাশি মাফলার, সুয়েটারসহ কয়েকটি আইটেমের শীতবস্ত্র তৈরির কাজ। দেশে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে এখন এখানে উৎপাদন হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার শীতবস্ত্র।
কক্সবাজার জেলা থেকে শীতবস্ত্র কিনতে আসা জহির উদ্দিন বলেন, অন্যান্য জায়গার থেকে এখানে কম দামে কিনতে পারছি বলেই এখানে প্রতি বছরেই শীতের গরম কাপড় কিনতে আসা হয়। তবে এখানে ব্যাংকের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়তে হয়। আমাদের কথা বিবেচনা করে দ্রুত ব্যাংক স্থাপনের দাবি করেন তিনি।
সাদিয়া এন্ড তামিম হোসিয়ারির মালিক আমিনুল ইসলাম বলেন, এ উপজেলার দুই তিনটি ইউনিয়নসহ পাশ্ববর্তী বগুড়া জেলার কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষসহ প্রায় ৫ হাজারের মতো মানুষ এই পেশার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সারা বছরই শীতের পোষাক তৈরি হলেও এসময়টাই বিক্রি হয় বেশি। এখানকার শীতবন্ত্র এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের নামকরা শো-রুমে বিক্রি হচ্ছে। এ বাজার প্রতি দিনেই দেড় কোটি টাকার বেশি বিক্রি হয়ে থাকে।
সূচী ফ্যাশনের মালিক আসাদুজ্জামান মজনু বলেন, আমাদের এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে কোনো ব্যাংক না থাকায় টাকা লেনদেন করতে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তাছাড়া ব্যাংক থাকলে ঋণ নিয়ে ব্যবসা আর বড় করা যেত।
ইয়াসমিন হোসিয়ারী মালিক জাকিরুল ইসলাম বলেন, পুরো বছর ধরে উৎপাদিত শীতবস্ত্র সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। যত শীতের তীব্রতা বাড়বে ততই বেচাবিক্রি বাড়বে আমাদের। তবে এবার আশা করা যাচ্ছে শীত বেশি হবে। আমরা সেভাবে মালমাল বানিয়ে প্রস্তুত করে রেখেছি। তাই এবার ব্যবসাও ভালো হবে বলে আশা করা যায়।
নয়ারহাট হোসিয়ারী শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোফাক্কের হোসেন ইকবাল বলেন, কোচাশহর থেকে নয়ারহাটে আসার রাস্তাটিও বেশ সরু। যার কারনে ট্রাকসহ বড় গাড়ি এখানে আসতে না পারায়, মালামাল ভ্যান বা ছোট পিকআপে করে কোচাশহরে নিতে দ্বিগুণ খরচ এবং চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান মোল্লা বলেন, আমরা জানি যে এই কোচাশহর ইকোনমিক হাব হিসেবে এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যবসার কেন্দ্র এখানে। আমি বিভাগীয় সম্মেলনে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সচিব স্যারকে বলেছি যাতে এই কোচাশহরের হোসিয়ারি পল্লীকে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়।
তোফায়েল হোসেন জাকির 























