বর্তমান একবিংশ শতাব্দিতে সারা বিশ্বে বিরাজ করছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। পরিবার থেকে রাষ্ট্র সব জায়গায় পুরুষের আধিপত্য। কিন্তু চীনের ইউনান প্রদেশে ঠিক তার উল্টো চিত্র দেখা যায়। অঞ্চলটি তথাকথিত নারী শাসিত এক অভিনব সাম্রাজ্য।
দক্ষিণ পশ্চিম চীনে হিমালয়ের কোলে বাস করে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক এক সম্প্রদায়। যার নাম মসুও। এই সমাজের নারীরাই সর্বেসর্বা, পুরুষরা গৌণ। পুরুষের যৌন সংসর্গ ছাড়া যেহেতু সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়, তাই মসুও সমাজে পুরুষের প্রয়োজন ভবিষ্যত বংশধর তৈরির জন্য। এর বাইরে পুরুষের সাথে সম্পর্ককে তাদের সমাজে নিরুৎসাহিত করা হয়।
মসুও একটি ছোট প্রাচীন সম্প্রদায়। সংখ্যায় তারা ৪০ হাজারের মতো। মূলত স্বনির্ভর জাতিগোষ্ঠী। কঠোর ধর্মবিশ্বাস আর সংস্কৃতি কেন্দ্রিক তাদের জীবনযাপন।
মসুওদের লোক সংস্কৃতিতে তাদের বিশ্বাস যে পুরুষের ভূমিকা হল শুধু সন্তান উৎপাদনে সাহায্য করা। তাদের ব্যাখ্যায় – নারীর শরীরে নতুন জীবনের যে বীজ সুপ্ত আছে, পুরুষ তাকে অঙ্কুরিত করবে। সেই বীজে যখন প্রাণের সঞ্চার হবে, তখন থেকেই সেই শিশুর মালিক তার গর্ভধারিণী মা। বাবার ওই শিশুতে কোন অধিকার নেই। সে শুধু বীজে পানি দিয়ে তাকে অঙ্কুরিত করেছে। ঐটুকুই তার ভূমিকা। শিশুর জীবনে বাবার আর কোন ভূমিকাই থাকে না সেখানে।
মসুও পরিবারে শিশুরা যেহেতু মায়ের বাড়িতে বেড়ে ওঠে, তাই ঘরে পুরুষ বলতে বাবার চেয়ে তারা বেশি চেনে মামাকে বা মায়ের বংশের যে পুরুষ সেই পরিবারে থাকেন তাকে।
সন্তানের বাবার পিতৃত্বে কোন অধিকার থাকে না। আমরা বাবা বলতে যেটা বুঝি মসুও সমাজে বাবারা কিন্তু সেরকম নয়। সন্তানের বড় হয়ে ওঠার ব্যাপারে তাদের কোনই দায়িত্ব থাকে না। সব দায়িত্ব নেন মামারা।
বোনের বাচ্চাদের মসুও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া, তাদের জীবনযাপন, মূল্যবোধ সবকিছু যথাযথভাবে শেখানোর দায়িত্ব মামাদের।
মসুও জনগোষ্ঠীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন আইনজীবী চু ওয়াই হং। তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করতেন সিঙ্গাপুরে একটা বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ আইনজীবী হিসাবে। ওই বছর তার শহুরে ব্যস্ত জীবন থেকে আগাম অবসর নিয়ে যখন তার পূর্বপুরুষের দেশ চীনে বেড়াতে যান, তখন হঠাৎই তিনি দেখা পান পাহাড়ের বাসিন্দা এই বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ের। সঙ্গে সঙ্গে তাদের দারুণ ভাল লেগে যায় তার।
চু ওয়াই হং বলেন, নারীরা সেখানে দারুণ ক্ষমতাশালী। আপনি সেখানে গেলে দেখবেন এই সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস। তবে সেটা কিন্তু তাদের স্বভাবজাত। আমাদের নারীদের মধ্যে এটা সচরাচর দেখা যায় না। এরা কিন্তু সেভাবে শিক্ষিত নয়, এরা কৃষক, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে এরা যেন টগবগ করছে!
তিনি জানান, পাহাড়ের প্রায় ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় অপূর্ব সুন্দর একটা হ্রদ – নাম ‘লুগু লেক’। তার চারপাশে চমৎকার ঝাউবন। পাহাড়ে ঘেরা চোখ জুড়ানো দারুণ এলাকা। প্রত্যেকেই কৃষিজীবী আর খুব শান্ত ধীরস্থির জীবনযাত্রা সেখানে।
চু ওয়াই হং যখন ২০০৬ সালে লুগু লেকে যান, তখন সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা প্রায় ছিলই না। বাইরের মানুষের প্রভাবও তেমন পড়েনি। তিনি তখনও ভাবেননি যে সেখানেই তিনি ভবিষ্যতে তার ঘর বাঁধবেন।
মিজ ওয়াই হং যেদিন সেখানে গিয়ে পৌঁছান, সেদিন মসুও নারীরা তাদের প্রথাগত উজ্জ্বল সাজপোশাক পরে তাদের পাহাড়ের দেবীর উৎসব উদযাপন করছিলেন।
তিনি বলেন, তারা খুব মজা করে নাচ-গান করছিল, আগুন জ্বালিয়ে খাবার রান্না করছিল আর পর্বতের দেবীর সামনে ধূপ জ্বালাতে সবাই পাহাড় ভেঙে উপরে উঠছিল। পাহাড়ের মাথায় তাদের দেবী ‘গামু’র মন্দির। তাদের বিশ্বাস এই দেবীই তাদের রক্ষাকর্ত্রী। তারা বলে, তাদের এই দেবী নাচগান ভালবাসেন, মদ্যপান, বহুগামিতা তার খুব পছন্দ। তাই এই দেবীকেই তারা অনুসরণ করেন।
মসুও নারীদের বক্তব্য – দেবীর মত আমাদের জীবনেও একাধিক পুরুষসঙ্গী চাই। আমরা একজনের সাথে আটকে থাকতে চাই না।
মসুওদের জীবন নিয়ে তিনি বই লিখেছেন ‘কিংডম অফ উইমেন’। মসুওদের ভাষাও শিখেছেন তিনি, তাদের সাথে বসবাস করেছেন।
প্রথাগতভাবে মসুওরা মাতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ তাদের বংশ পরম্পরা মায়ের দিক থেকে। তাদের সমাজে মাতামহী বা প্রমাতামহী সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। মেয়ে মায়ের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।
মসুও পরিবারের কন্যারা ভাই বা ছেলের ভরনপোষণের দায়িত্ব নেয়। ছেলেরা কখনও বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না। বোনের পরিবারেই থাকে। তবে ভবিষ্যত প্রজন্মে পরিবারের মাথা কে হবে, সেটা কোন্ কন্যাসন্তান পরিবারের অগ্রজ, সেটা বিচার করে তারা ঠিক করে না। পরিবারে যে কন্যা সন্তান সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, আর সবচেয়ে পরিশ্রমী সেই পরিবারের মাথা হয়।
মেধা ও কর্মদক্ষতা বিচার করে সেটা ঠিক করে দেন পরিবারে মায়ের দিকে জীবিত সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ নারী। পরিবারে সবাইকে তিনি নির্দেশ দিয়ে জানিয়ে দেন ভবিষ্যতে ওই পরিবার কার কর্তৃত্ব মেনে নেবে।
মসুওদের সমাজে নারী পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারটাও একেবারেই অন্যরকম। বিয়ে বলে তাদের সমাজে কিছু নেই। নারী আর পুরুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কেও তারা বিশ্বাস করে না।
মসুও সমাজে একজন পুরুষ, নারীকে বলে- আজ রাতে আমি তোমার বাসায় কাটাব। মসুওদের বাসায় প্রত্যেক নারীর আলাদা ঘর থাকে। পুরুষ এসে রাতে তার পছন্দের নারীর দরোজায় পাথর দিয়ে টোকা মারে ও তার ঘরে রাত কাটায়।
ওই পুরুষকে সূর্য ওঠার আগেই কিন্তু ঘর থেকে চলে যেতে হয় তার নিজের বাসায়। মসুওরা এটাকে বলে ‘পথচলতি বিয়ে’। তারা কখনই এই পথচলতি বিয়েকে স্থায়ী কোন এই সম্পর্ক হিসাবে দেখে না, বা দেখার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে না। তাদের যুগল সম্পর্ক শুধু রাতের ওই মুহূর্তটির জন্যই স্থায়ী হয়,” বলেন মিজ ওয়াই হং।
চু ওয়াই হং মসুওদের গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকবার থাকার পর গ্রামের বাসিন্দারা তাকে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাবার অনুরোধ জানান।
মসুও সমাজে পুরুষরা ছোটবেলা থেকেই নারীদের সম্মান করতে শেখে। নারীর প্রতি সম্মানবোধ নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে।
যে কর্মপরিবেশে, যে সমাজে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন, সেখানে দেখেছেন, প্রচুর পুরুষ সহকর্মীর মধ্যে কোন মেয়ের বক্তব্য তুলে ধরা কতবড় একটা সংগ্রাম। তাই বলে মসুও নারীরা কিন্তু পুরুষদের কখনই হেয় করেন না।
পুরুষপ্রধান দুনিয়ায় পুরুষরা নারীদের প্রতি যেভাবে আচরণ করে, তাদের যে চোখে দেখে, মসুও সমাজ নারীপ্রধান হলেও নারীরা কিন্তু পুরুষদের একইভাবে দেখে না। তারা পুরুষের ওপর প্রভুত্ব করে না। পুরুষদের গালমন্দ করে না। তাদের প্রতি মসুও নারীরা খুবই মমতাশীল।
মিজ ওয়াই হং বলেন, পুরুষরাও সেই সমাজে কখনও নিজেদের অধস্তন বা অবদমিত বলে মনে করে না। তাদের সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে একটা সাম্য আমি দেখেছি।
মসুও এলাকায় এখন পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে তারা এখন চীনের আধুনিক জীবনধারার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পাচ্ছেন।
অনেক মসুও নারী একজন জীবনসঙ্গীর সাথে ঘর বাঁধার আইডিয়াও পছন্দ করতে শুরু করেছেন।
তবে সমাজে নারীর সম্পর্কে পুরুষের যে প্রচলিত ধ্যানধারণা রয়েছে প্রাচীন এই মসুও সমাজ তার অনেক কিছুকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। মাতৃতান্ত্রিক একটা সমাজ কতটা সুশৃঙ্খল ও কার্যকর হতে পারে মসুও সমাজ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
সূত্র : বিবিসি
জাগো২৪.নেট, আন্তর্জাতিক ডেস্ক 
























