লুৎফর রহমান (৭২)। ১৯৭২ সালে করেছেন ম্যাট্রিকে পাস। দারিদ্রতার নির্মম কষাঘাতে বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। বাধ্য হয়ে শুরু করেন টিউশনি পেশা। সম্মানি হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দৈনিক নেওয়া হয় এক টাকা। এভাবে প্রায় ৫০ বছর ধরে অব্যাহত রাখছেন এই শিক্ষকতা। এখন এক টাকার মাস্টার হিসেবে সবাই চেনেন এই শিক্ষানুরাগী লুৎফর রহমানকে।
তার বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামে। সেখানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ধারে টিনের ঘরে কোনমতে বসবাস লুৎফর রহমানের।
স্থানীয়রা জানান, অভাব-অনটন আর দারিদ্রতার মাঝে ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় লুৎফর রহমানের পড়ালেখা। নিজের সেই আক্ষেপ লুকিয়ে শিক্ষার্থী ঝড়েপড়া রোধ ও গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষার আলো ছড়ানোর ব্রুত নেন তিনি। একারণে কোথায়ও চাকরি না করে ১৯৭২ সাল থেকে সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে প্রথমে বিনামূল্যে পরিশ্রমে পড়ানো শুরু করেন। ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন গাছতলা, আঙিনা কিংবা বাঁধের ধারে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দিয়ে যাচ্ছিলেন লুৎফর রহমান মাস্টার। এই পেশায় অব্যাহত রেখে স্থানীয় অভিভাবকদের অনুরোধে প্রতিদিন এক টাকা করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নিয়ে পড়ানো শুরু করেন। এভাবেই পাঁচ দশকের শিক্ষকতা করে চলেছেন। একারণে এক টাকার মাষ্টার হিসেবেই পরিচিতি অর্জন করেছেন তিনি।
স্বজনরা জানায়, একসময় ৮০ বিঘা জমি, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু সবই ছিল লুৎফর রহমান পরিবারের। কিন্তু ১৯৭৪ সালের বন্যা ও নদী ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হন তারা। পরে আশ্রয় নেন বাগুড়িয়া গ্রামের ওয়াপদা বাঁধে। স্ত্রী লতিফুল বেগমসহ দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার তার। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে লাভলু এসএসসি পাস করার পর অর্থাভাবে আর পড়তে পারেনি। এখন অটোরিকশা চালায় ছেলেটি। ছোট ছেলে মশিউর রহমান একটি মাদ্রাসা থেকে মাস্টার্স সমমানের (দাওরা) পাস করে বেকার রয়েছেন।
জলিল উদ্দিন নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি জাগো২৪.নেট-কে জানান, ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হন লুৎফর রহমান। এরপর পায়ে হেঁটে, কখনো বাইসাইকেল চালিয়ে পথ পাড়ি দেন তিনি। পাশের বাগুড়িয়া, মদনেরপাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া, মধ্যপাড়া ও পূর্বপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের শিক্ষার্থী পড়ান।
খাজা মিয়া নামের আরেক প্রবীণ ব্যক্তি জাগো২৪.নেট-কে জানান, লুৎফর রহমানের লক্ষ্য প্রাথমিকে ঝরে পড়াসহ ভাঙনকবলিত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে বই, খাতা, কলমসহ তাদের নিয়ে কখনো রাস্তার ধারে, বাঁধে কিংবা বসে পড়েন গা ছতলায়। বর্তমানে তার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ জন। প্রতি ব্যাচে ১০ করে পাঠদান করেন।
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জেসমিন খাতুন জাগো২৪.নেট-কে বলে, লুৎফর স্যার অনেক আদর করে। বাড়িত আসি পড়ায়। তার কাছে পড়তে ভালো লাগে।
লুৎফর রহমানের স্ত্রী লতিফুন বেগম জাগো২৪.নেট-কে বলেন, পড়ালেখা শিখানোই তার নেশা। কখনও হেঁটে আবার কখনও বাইসাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে শিশুদের পড়ালেখা করাচ্ছেন।
লুৎফর রহমান মাস্টার জাগো২৪.নেট-কে জানান, যমুনা নদীবেষ্টিত ওয়াপদা বাঁধের চারপাশের গ্রামগুলো বন্যাকবলিত। বেশির ভাগ মানুষ গরিব। সন্তানদের পড়াতে অনীহা দেখান অভিভাবকরা। সে জন্য নামমাত্র গুরু দক্ষিণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেখান তিনি। ম্যাট্রিক পাস করার পর অর্থাভাবে তিনি কলেজের বারান্দায় পা রাখতে পারেননি। এই না পাওয়ার বেদনা ভুলতেই শিক্ষার্থী পড়োনোর নেশা তার।
তিনি আরও বলেন, সেই সমেয় মানুষের ঘরে ঘরে অভাব। প্রথমে বিনা পয়সায় পড়াইছি। পরে এক টেকা করি নিছি। এখনও যে যা দেয় তাই নেই। আমার ছাত্র অনেকেই ভালো ভালো জায়গায় গেছে। সরকারি ডাক্তার, প্রভাষক, কলেজের প্রিন্সিপালও হয়েছে। এসব মনে হলে, সব কষ্ট ভুলে যাই।
স্থানীয় সমাজকর্মী ও সাবেক ছাত্র বদিয়াজ্জামান মিয়া জাগো২৪.নেট-কে বলেন, বিখ্যাত কিছু দার্শনিকের নাম জানি। যেমন, প্লেটো, সক্রেটিস। তারা গ্রামগঞ্জ-হাটে-বাজারে গিয়ে মানুষদের সমাবেত করে জ্ঞান দান করতেন। ঠিক লুৎফর স্যারের পাঠদান পদ্ধতিটাও এ রকম।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে গিদারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ ইদু জাগো২৪.নেট-কে বলেন, লুৎফর মাস্টার একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। মাত্র এক টাকার বিনিময়ে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।
তোফায়েল হোসেন জাকির 






















