রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৪:৪৯ পূর্বাহ্ন

ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যায় এখনো পিছিয়ে চরাঞ্চলের কিশোরীরা

আফসানা আক্তার মিমি, লাইফস্টাইল করেসপন্ডেন্ট, জাগো২৪,নেট
  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২৪

(আফসানা আক্তার মিমি)

বরাবরই পিছিয়ে গাইবান্ধা জেলার চরাঞ্চলের কিশোরীরা। জেলার সাতটি উপজেলার ১৬৫টি চরে রয়েছে কয়েক হাজার কিশোরী। যারা কোনো মতো প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোলেও সুযোগ পায় না উচ্চ শিক্ষার। প্রান্তিক পর্যায়ে বেড়ে ওঠা এসব মেয়ে স্বভাবতই ডানপিঠে স্বভাবের। অর্থাৎ হাতে পায়ে লম্বা। তবে, অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় তেমনভাবে যুগের সাথে তাল মেলাতে পারেনি তারা। ফলে শহুরে কিশোর-কিশোরীদের মতো কোনো বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলার চর্চা তেমন নেই বলে তাদের অভিজ্ঞতাও স্বল্প।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি চর; যেখানে পৌঁছাতে পেরোতে হয় ইঞ্জিনচালিত নৌকা। যাওয়া যায় ডিঙি নৌকাতেও। এ চরে পরিবারগুলো তেমন স্বচ্ছল নয়, নেই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও। এমতাবস্থায় এ চরের কিশোরী মেয়েদের মধ্যে পড়ালেখার আগ্রহ দেখা গেলেও পারিপার্শ্বিক চাপে তা হয়ে উঠে না।

এদিন নৌকা থেকে নামা মাত্রই কয়েকজন শিশুসহ ঘিরে ধরে কিশোর-কিশোরীরা। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, কে কি করেন? চম্পা নামে গোলগাল চেহারার ১২ বছর বয়সী মেয়েটি বলে উঠলো পঞ্চম শ্রেণি পাস করার কথা। অন্যদিক থেকে রুগ্ন দেখতে কিশোরী মেয়েটি বললো, অস্টম শ্রেণিতে পড়ছে, তাও অনেক যুদ্ধ করে। ভাবলাম কাজটা সহজ হলো। যেহেতু মাধ্যমিকে পড়ে। কিন্তু ভাবিনি এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। প্রশ্নটি ছিলো-মাসিককালীন সময়ে তারা কিভাবে নিজেদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে? আর এই প্রশ্ন করা মাত্রই তারা দিলো এক ছুট। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তবতা। এখনও চরাঞ্চলের বেশিরভাগ কিশোরীরাই জানেন না কিভাবে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যা করতে হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, শুধু কিশোরীরা নয়, অভিভাবকরাও এ বিষয়ে কারও সাথে কথা বলতে চায় না। নছিরন নামে এক অভিভাবক  তো বলেই বসলেন, লাজ-শরম নাই নাকি, এগলা কতা জিগান..? তার মেয়েটিও পাশে দাড়িয়ে ক্ষুদ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। অনেক কথা বলেও তাদের সহজ করা গেলো না।

এমতাবস্থায় যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরছিলাম তখন ১৮-২০ বছর বয়সী এক মেয়ে ছুটে এলেন এক ছেলে কোলে নিয়ে। বলতে লাগলেন, এ চিত্র আজ নতুন নয়। দেখতে ছোট  মনে হলেও কুন্তি নামের এই মেয়েটির বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। ইতোমধ্যে হয়েছে দুই বাচ্চার মা। গল্পে গল্পে জানা গেলো তার বাবার বাসা ফুলছড়ির টেংরাকান্দি চরে। এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে উঠে নি। সেই কষ্ট বুকে ধারণ করে বিয়ে করে আসলেও শ্বশুরবাড়ি এসে পাননি অনুকূল পরিবেশ। মাসিককালীন সময়ে স্বামীর কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে চেয়ে অত্যাচারের শিকারও হয়েছেন তিনি। পরিবারের অন্য সদস্যরাও কোনো প্রতিবাদ করেন নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন এখানে এই বিষয়টি এখন গুপ্ত। কেউ এ বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেন না।

আর এ চিত্র শুধু ওই চরে নয়; জেলার বিভিন্ন চরের প্রেক্ষাপটও একই রকম। প্যাডের পরিবর্তে ব্যবহার করছেন কাপড় বা ন্যাকড়া। শুকাতে দিচ্ছেন ঘাস বা মাঠে। এতে জীবাণুনাশকের পরিবর্তে বিভিন্ন জীবাণু বাসা বাধঁছে ওইসব ব্যবহৃত জিনিসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিশোরীর সাথে কথা হলে জানা যায়, কাপড় জীবাণুমুক্ত না হওয়ায় জরায়ুর সমস্যায় ভুগতে হয়েছে অনেক দিন। এরপর থেকে একটু সচেতন হলেও অর্থের অভাবে সবসময় হয়ে উঠেনা স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা। দৃশ্যমান এ পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করছেন বিভিন্ন জিও-এনজিও। তবে, এ বিষয়ে জড়তা কাটাতে ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিজ উদ্যোগেই এগিয়ে আসতে হবে কিশোর-কিশোরীদের-এমনটাই মত ফিল্ড অফিসারদের।

গাইবান্ধা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যমতে, মাসিককালীন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করতে বিদ্যমান বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি দ্বারা বিভিন্ন সচেতনতামূলক তথ্য, লিফলেট ও সেবা দেয়া হচ্ছে। কাজ চলছে এসব বিষয়ে জড়তা ভাঙ্গার।

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের গাইনী বিশেষজ্ঞ তাহেরা আক্তার মনি বলছেন, ‘‘মাসিকের সময় অপরিষ্কার পুরাতন কাপড় ব্যবহার করলে জ্বর, তলপেটে ব্যথা ও মূত্রনালীতে সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়া জরায়ুতে ইনফেকশন হতে পারে। ইনফেকশন দীর্ঘদিন থাকলে পরবর্তিতে সেটি জরায়ুর ক্যানসারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পুরনো, অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারে পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তপাতের সম্ভাবনাও থাকে’’।

২০১৩ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং ওয়াটার এইড সংস্থার সহায়তায় করা আইসিডিডিআরবি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৬ ভাগ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করে পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন।

স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে অনিয়মিত ব্যবহারকারীসহ মোট ১৪ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতেন। এখন তা ব্যবহারে ২০ শতাংশে উন্নতি হয়েছে।

শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর

© ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | জাগো২৪.নেট

কারিগরি সহায়তায় : শাহরিয়ার হোসাইন