আফসানা আক্তার মিমি: ‘প্রতিনিয়তই কল করতো, একটা নাম্বার ব্লক করতাম তো আরেকটা দিয়ে কল করতো। এক সময় ব্লক করতে করতে আমি পাগলপ্রায়। আব্বু-আম্মুকেও বলতে পারতাম না, ভয় হতো যদি ভুল বুঝে। কিন্তু পানি যখন মাথা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম তখন বাধ্য হয়ে ভাইয়াকে বলি। প্রথমে ভাইয়া শুনে খুব রাগারাগি করে, তারপর ভরসা দেয়। নাম্বার নিয়ে নিজে কথা বলে, ভাইয়াকেও আমার বিভিন্ন অশ্লীল ছবি পাঠায়। অর্থ দাবি করে, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। পরে ভাইয়া বিষয়টা তার এক পুলিশ বন্ধুর সাথে শেয়ার করে। বুদ্ধি করে দুই বন্ধু টাকা দেয়ার নামে ফাঁদ পাতে। ধরাও পড়ে সে। কিন্তু অবাককর বিষয় এভাবে হুমকি দেয়া, ব্লাকমেইল করা মানুষটা অপরিচিত কেউ নয়, আমাদের নিকটাত্মীয়। এজন্য পরে থানা-পুলিশ করা হয় নি। কিন্তু বিষয়টা এখনও ভাবলে গা শিউরে উঠে।
গল্পে গল্পে নিজের জীবনের এক কালো অধ্যায়ের পাতা উল্টাচ্ছিলেন গাইবান্ধার কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী হেনা। আর এরকম ঘটনা শুধু হেনার সাথে নয় প্রতিনিয়তই ঘটছে উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীর সাথে।
ঢোলভাঙ্গার তিথীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ফুলছড়ির চর থেকে এক ছেলে অযাচিতভাবে কল আর মেসেজ দিতো। প্রথমে তেমন গুরুত্ব না দিলেও দিনকে দিন এর উপদ্রুব বাড়তে থাকে। বাবা খুব রাগ হতো। পরে ওই ছেলের সাথে কথাও বলে আব্বু। কিন্তু কাজ হয় না। বাধ্য হয়ে জিডিও করি। এরপর পুলিশি হস্তক্ষেপে সমস্যা সমাধান হয়। কিন্তু রাতের বেলা মোবাইল আর নিজের কাছে রাখতাম না।
এ বিষয়ে কথা হয়, গাইবান্ধা সদর উপজেলার এক নারী উদ্যোক্তা বৃষ্টির সাথেও। কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই অনলাইনে হস্তশিল্পের কাজ করতেন। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়েও তাকে শিকার হতে হয় সাইবার বুলিংয়ের। বিভিন্ন লাইভে কটুক্তিসহ হ্যাক করে নেয়া হয় তার বিজনেসের অনলাইন পেজটি। এতে ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সাথে ব্যবসায়িক দিক থেকেও তাকে ক্ষতির সম্মখিন হতে হয়। এক বৃষ্টি নয়; ব্যবসা বা অনলাইন প্লাটফর্মে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করার লড়াইয়ে এ রকম হয়রানির শিকার হন বিথী বেগমও। মূলত সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করাসহ অন্যের ক্ষতি করাটাই সাইবার বুলিংকারীদের লক্ষ্য বলে জানান ভুক্তভুগিরা।
অভিভাবকরা বলছেন, সন্তানদের খোঁজখবর রাখার জন্য মোবাইল ফোন কিনে দিলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা হয়রানির শিকার হচ্ছে। যা খুবই অপ্রত্যাশিত।
হাসিনা বেগম নামে এক অভিভাবক বলেন, গত বছরই আমার মেয়ে মোবাইলে হয়রানির শিকার হয়ে গাইবান্ধা সদর থানায় জিডি করে। এরপর পুলিশের সহায়তায় যেই যুবক হয়রানি করছিলো তাকে থানায় এসে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর আর কোনো অসুবিধা হয় নি।
অপর এক অভিভাবক মশিউর রহমান বলেন, সাইবার বুলিংকারীদের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এদের জন্য আমাদের সন্তানদের নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকতে হয়। যদিও আমাদেরও কিছুটা দোষ আছে। ছেলে-মেয়েরা কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে আমরা খবর রাখি না। এসব বিষয়ে আমরা সচেতন হলেও এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সময়ের পরিক্রমায় সাইবার বুলিংয়ের সমস্যা বিস্তর আকার ধারণ করছে। এ অবস্থায় গাইবান্ধার সব স্কুল-কলেজেও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
গাইবান্ধার পুলিশ লাইন্স স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুকমল মজুমদার জানান, সবকিছুরই ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। তবে, সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা নিরসনে অভিভাবকদের সচেতনতার বিকল্প নেই। আমরা স্কুলের সমাবেশ, অভিভাবক সভাসহ বিভিন্ন ইভেন্টে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছি, পরামর্শ দিচ্ছি। যা এখনও চলমান।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, গাইবান্ধা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও গণমাধ্যমকর্মী রিক্তু প্রসাদ বলেন, যুগের সাথে তাল মেলাতে অবশ্যই আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে হচ্ছে। তবে, সম্প্রতি সাইবার বুলিংয়ের মতো ঘটনা চোখে পড়ার মতো। এ বিষয়ে অনেক অভিযোগ পরিষদে আসে। আমরা প্রতিনিয়ত লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে সহায়তা করছি। তবে, এই সমস্যা নিরসনে অভিভাবকদের সাথে কিশোরীদের অধিক সচেতন হতে হবে। আর এ সংক্রান্ত ঘটনায় সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান এই গণমাধ্যমকর্মী।
অন্যদিকে, এসকেএস ফাউন্ডেশনের আইটি বিভাগের সমন্বয়কারী জহুরুল ইসলাম বিশ্বাস বলছেন, শুধু সচেতনতা দিয়ে সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা কমানো সম্ভব নয়। এজন্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারকারীদের কারিগরী দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। বিভিন্ন ফিচার সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে হবে। অনেকে না বুঝেও অযাচিত মানুষ ও গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। যা পরবর্তীতে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে সম্মানহানিকর। আর অবশ্যই এ সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে।
গাইবান্ধা সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সেরাজুল হক বলেন, মূলত এ বিষয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রংপুর-এ জিডি বা মামলা বিভাগীয় পর্যায়ে করা হয়ে থাকে। এরপর বিভাগীয় পর্যায় থেকে নির্দেশনা মোতাবেক অধিক গুরুত্ব সহকারে মামলা তদন্ত করা হয়। যেহেতু এ বিষয়ে কিশোরীরাই বেশি হয়রানির শিকার হয়। এছাড়া থানায় এসে কোনো কিশোরী বা নারী বা অভিভাবক বা কোনো ব্যক্তি অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিকভাবে সেবা দেয়া হয়।
গাইবান্ধা সদর থানার তথ্যমতে, গত ৬ মাসে থানায় সাইবার বুলিং সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ বা মামলা দায়ের হয় নি। তবে, সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রংপুর-এ করা দুইটি মামলা গাইবান্ধায় তদন্ত করা হচ্ছে।
© ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | জাগো২৪.নেট