এক সময়ের চির চেনা তিস্তা পরিনত হয়েছে মরা খালে। চারদিকে শুধু ধুধু বালুচর। খরস্রোতা আর উত্তাল তিস্তা বসন্তে হারিয়ে ফেলেছে যৌবন। নদীতে যতটুকু পানি থাকলে এর অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে সেটুকুও পানি নেই তিস্তায়।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তিস্তার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নদীর দুই পাশে প্রটেক্টিভ বাঁধ দিয়ে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করতে পারলে ফিরে পাবে তিস্তার চিরচেনা রুপ।
জানা যায়, ১৯৭৯ সালে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৯০ সালে শেষ হয়। সেই সময় ব্যারাজ নির্মাণে ২,৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রধান প্রকৌশলীর বরাত দিয়ে তিস্তার বামতীর রক্ষা কমিটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে যে টাকা খরচ হয়েছে তার ৫% খরচ করলে তিস্তা ব্যারাজ থেকে কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটারে প্রটেক্টিভ বাঁধ দেয়া যেত।
এর সত্যতা মেলে ব্যারাজ প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শনে। সেখানে এক্সেভেটর, বুলডোজারে নদীশাসনসহ নদীসংশ্লিট কোটি কোটি টাকার মালামাল অযন্তে পড়ে আছে। এসব অকেজ ও বহু পুরোনো যন্ত্রপাতি সাধারণ মানুষের কাছে পিকনিক অনুষ্ঠানের অণুষঙ্গ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে।
এদিকে এখন নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষায় একটু পানি হলেই পাড় উপচে পড়ে। বর্ষার সময় নির্ধারণ করা নদীর বিপৎসীমা রের্কড পরিবর্তন হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাট দপ্তর রেকর্ড পরিবর্তনের হিসাব দিতে পারেনি। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের বিভাগীয় উপ-প্রকৌশলী কৃষ্ণ কমল চন্দ্র সরকার জানান, গত ৫ বছরে তিনবার রেকর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে। ৫২.২৫,৫২.৪০ বর্তমানে ৫২.৬০ সেন্টিমিটার করা হয়েছে।
জানা যায়, নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন প্রায় ১৪ হাজার কিউসেক। আর নদীর অস্তিত্ব বাঁচাতে প্রয়োজন পাঁচ হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু শুকনো মৌসুমে তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে বর্ষায় গড়ে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ দশ হাজার কিউসেক পানি আসে। এই পানি লালমনিরহাট অংশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরির্বতন হয়ে বারবার ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের ফলে নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার, যা দুই কিলোমিটার থাকার কথা।
কৃষি দপ্তরের তথ্য বলছে, লালমনিরহাটে চরকেন্দ্রিক ৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এর মধ্যে ভুট্টার পরিমাণ সব থেকে বেশি। এসব চরে অপরিকল্পিতভাবে সড়ক বাজারঘাট-বাড়ি ও বহুজাতিক কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদের প্রকল্পের কারণে চরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের নির্মমতায় অনেকটা স্থবির হতে চলেছে নদীর প্রাকৃতিক রূপ। এমন ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও চরের কৃষকরা শুধু কৃষিপরামর্শ বা চরকেন্দ্রিক আধুনিক কৃষির দাবি তুলেছেন।
তিস্তা গবেষকরা বলছেন, এক দিকে ভারত পানি প্রত্যাহার করছে, অন্যদিকে আমরাও পানি প্রত্যাহার করছি। আন্তঃসীমান্ত নদী হওয়াতে, এখানে পানি বণ্টন করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে।
নদীনির্ভর কৃষিতে ভাটা পড়ার চিত্র ফুটে ওঠে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে। সূত্র দুটি বলছে, বর্তমানে ২,০০০ কিউসেক পানি রিজার্ভ আছে। এই ২০০০ কিউসেক পানি তিস্তা নদী থেকে নিয়ে ক্যানেলে সরবরাহ করা হয়েছে। নদী সচল রাখতে ৪৪ গেটের মধ্যে ২টি গেট ৬ ইঞ্জিনের করে খুলে রাখা হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বাকি সব গেট বন্ধু থাকে। ক্যানেলগুলো লিজ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৩০ শতাংশ জমির ধান চাষে মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা গুনতে হয় কৃষককে।
ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্ট থেকে দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়াসহ পানি সরবরাহের জন্য করা ক্যানেলের আওতায় থাকা এলাকাতে চাষের জন্য পানি দিতে গেলে আরও ২,৮০০ কিউসেক পানি লাগবে। ভরা মৌসুমে এই ক্যানেলগুলোতে সর্বোচ্চ ২২০০ কিউসেক পানি ছেড়ে দেয়া হয়।
পানি উন্নয়নের অপর একটি সূত্রমতে, তিস্তা নদী বাঁচাতে কমপক্ষে ৫০০০ কিউসেক পানি প্রয়োজন। কিন্তু নদীতে পানি নেই। কতটুকু পানি হলে সচল রাখা যাবে ক্যানেলগুলো, তা জানা যাবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের পরে।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক প্রফেসর ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, নদীটিকে আমরা মেরেই ফেলেছি। প্রাকৃতিকভাবে নদী ভাঙলে এত ভয়াবহতা হতো না। নদী তখন নিজের গভীরতা তৈরি করত। তিস্তার বুকে কৃষি বা সবুজের যে বিপ্লব হয়, তা নদীর তলদেশের ক্ষতি করছে। তিস্তা প্রচুর পলি বহন করে। নদী যেন এক অবিভাবকহীন সত্তা। না আছে নিজের শক্তি, না আছে তাকে দেখার কেউ।
তিনি তিস্তা মহা পরিকল্পনার বিষয়ে বলেন, তিস্তা মহা পরিকল্পনায় জোরেসোরে হয়নি। বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকল্প নদী বাঁচাতে পারে। নদীর দুই পাড়ের মানুষদের বাঁচাতে পারে। তাহলেই নদী হয়ে উঠবে এই অঞ্চলের জীবন রেখা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী (পুর) মাহবুবর রহমান জানালেন, আশার কথা। তিনি বলেন, জয়েন্ট রিভার কমিশনের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে পানি বণ্টন নিয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আশা করি, দ্রত ফলাফল পাওয়া যাবে।