শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১১:২৮ পূর্বাহ্ন

এইদিনে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন গাইবান্ধাবাসী

তোফায়েল হোসেন জাকির
  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২২
আজ ৭ ডিসেম্বর। একাত্তরে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ি যুদ্ধের পর আজকের এইদিনে গাইবান্ধা সদরে হানাদার মুক্ত হয়। এরপরই লাল-সবজুরে পতাকা নিয়ে গাইবান্ধাবাসী বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। ফলে তারা গ্রহণ করেন মুক্তির স্বাদ।
জানা যায়, ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করে। ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানা। ৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় সুন্দরগঞ্জ। একে একে মুক্ত হয় সাদুল্লাপুর, সাঘাটা, পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ থানা।
সারাদেশের মতো গাইবান্ধাও একাত্তরের মার্চের শুরু থেকেই উত্তপ্ত হতে থাকে। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছিল বিভিন্ন এলাকায়। এক গণজমায়েতে পুড়িয়ে ফেলা হয় পাকিস্তানি পতাকা। আর শহরের সর্বত্র ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। বর্তমানে গণজমায়েতের ওই মাঠেই গড়ে তোলা হয়েছে বিজয়ের স্মৃতিস্তম্ভ।
২৪ মার্চ শহরের ভিএইড রোডস্থ বার্মা ব্যাংক ভবনে ছুটিতে আসা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা, নৌ, বিমান ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের এক সভায় প্রশিক্ষণ শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গাইবান্ধা কলেজ ও ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। প্রশিক্ষণ চলাকালে গাইবান্ধা কলেজের অধ্যক্ষ ওহিদ উদ্দিনের সহায়তায় রোভার স্কাউট ৩০০ কাঠের রাইফেল সংগ্রহ করে। যার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারদের গাইবান্ধা প্রবেশের আগ পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এরপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা চলে যায় ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে। সেখানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি দেশের ভেতরে তারা মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। নয় মাস ধরে চলে সশস্ত্র সংগ্রাম। একের পর এক আঘাত হানতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর।
গাইবান্ধার যুদ্ধগুলোর মধ্যে উল্লেযোগ্য যুদ্ধ হলো- বাদিয়াখালীর যুদ্ধ, হরিপুর অপারেশন, কোদালকাটির যুদ্ধ, রসুলপুর সুইস আক্রমণ, নান্দিনার যুদ্ধ ও কালাসোনার যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বিকেলে পাক হানাদার বাহিনী মাদারগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর হয়ে গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে। তারা টিঅ্যান্ডটির ওয়্যারলেস দখল করে। পরবর্তীতে গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে (বর্তমান শাহ আব্দুল হামিদ স্টেডিয়াম) ঘাঁটি করে। এই ঘাঁটি থেকেই তারা শহর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতন চালাতে থাকে। তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে মরদেহ মাটিতে পুঁতে রাখতে শুরু করে। বিভিন্ন রাস্তা-ঘাটের পাশেও অসংখ্য মরদেহ সেই সময় পুঁতে রাখা হয়। তাই এই স্থানগুলো পরে বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
এর মধ্যে গাইবান্ধা স্টেডিয়ামের দক্ষিণ অংশে এবং স্টেডিয়ামের বাইরে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। প্রতি রাতেই স্টেডিয়ামের পাশে কফিল শাহের গোডাউন নামে পরিচিত প্রাচীর ঘেরা এই এলাকায় দালালদের সহায়তায় অসহায় মানুষদের ধরে এনে পাকসেনারা নৃশংসভাবে হত্যা করতো। বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের এখানে এনে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। পার্শ্ববর্তী রেললাইনের কাছেও গর্ত করে মরদেহ পুঁতে রাখা হতো।
এদিকে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো গাইবান্ধাতেও মুক্তিযোদ্ধা এবং পাক সেনাদের লড়াই অব্যাহত থাকে।
তৎকালীস ২৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সতর্কতার সঙ্গে গাইবান্ধা শহরের দিকে এগোতে শুরু করে। কিছুদূর এসে রসুলপুর সুইচ গেট উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ডিনামাইট সেট করে। কিন্তু সেটা অকেজো হয়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা কিপাড়ায় চলে আসে। রসদ ফুরিয়ে গেলে সেখান থেকে তারা রসুলপুরে ফিরে যায়। এসময় পাকিস্তানি প্লেন থেকে ওই এলাকা এবং মোল্লারচরে বোমা বর্ষণ করলে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ৬ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুইটি প্লেন গাইবান্ধা রেলস্টেশনের পাশে বোমা ফেলে এবং বিকেলে ট্যাংক নিয়ে মিত্রবাহিনী প্রবেশ করে শহরে। পরে ৭ ডিসেম্বর কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক মাহবুব এলাহী রঞ্জুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের কালাসোনার চর থেকে বালাসী ঘাট হয়ে গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে।
এদিকে, তাদের আগমণের সংবাদ পেয়ে আগের রাতেই গাইবান্ধা শহরের স্টেডিয়ামে অবস্থিত পাক সেনা ক্যাম্পের সৈনিকরা রংপুর ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে পালিয়ে যায়। ফলে বর্তমান স্বাধীনতা প্রাঙ্গণ ও তৎকালীন এসডিও মাঠে ৭ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা-জনতার মিলনমেলায় পরিণত হয়। দশ হাজারেরও বেশি মানুষ সংবর্ধনা জানায় বিজয়ী বীর সেনাদের।
এর দুইদিন পর আব্দুর রহিম কোম্পানিকে সুন্দরগঞ্জ, এমএন নবী লালু কোম্পানিকে পলাশবাড়ি, খায়রুল আলম কোম্পানিকে সাদুল্লাপুর, আমিনুল ইসলাম সুজা কোম্পানিকে গোবিন্দগঞ্জ, রোস্তম আলী খন্দকার ও শামছুল আলম কোম্পানিকে সাঘাটা ও ফুলছড়ি এবং সুবেদার আলতাফ হোসেন কোম্পানি ও মাহবুব এলাহী রঞ্জু কেম্পানিকে গাইবান্ধা সদর থানার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাভাবিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালুর আগ পর্যন্ত মাসখানেক তারা এ বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন।
আজ বুধবার ( ৭ ডিসেম্বর) মহান এই দিবস উপলেক্ষ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গাইবান্ধায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর

© ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | জাগো২৪.নেট

কারিগরি সহায়তায় : শাহরিয়ার হোসাইন