শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৪:২৭ অপরাহ্ন

ভাবির মোড়ে ভাবিদের হোটেলে স্বাদেভরা হাঁসের মাংস

মোসলেম উদ্দিন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট জাগো২৪.নেট, দিনাজপুর
  • প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০২৩
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ সীমান্তে রাণীর ঘাটে ভাবিদের হাঁসের মাংসের হোটেল। বর্তমান এই স্থানটি ভাবির মোড় হিসেবে পরিচিত। এই মোড়ে রয়েছে চার ভাবির নামে চারটি হোটেল। ভাবির হোটেলগুলোতে সস্তা ও সুস্বাদু হাঁসের ভুনা মাংসের জন্য বিখ্যাত। হোটেলে নেই কোন পুরুষ কর্মচারী, খাবার পরিবেশন করা, ক্যাশে টাকা নেওয়া সহ সব কাজ করেন নারী শ্রমিকরা। হোটেল ব্যবসা করে ভাবিরা হয়ে উঠেছে আজ স্বাবলম্বী।
উপজেলার রাতইল ইউনিয়নের ভাবির মোড়ে ভাবি-১ মাসতারা বেগম, ভাবি-২ তাসলিমা আক্তার, ভাবি-৩ মেরিনা পারভীন ও ভাবি-৪ বেলী আক্তারের হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছেন হোটেলগুলোতে ভাবিদের নিজ হাতের রান্না করা হাঁসের মাংসের খেতে। মোটরসাইকেল, অটোগাড়ি এবং কি কার ও মাইক্রোবাস যোগে আসছেন এসব তাদের হোটেলের সুস্বাদু খাবার খেতে। অনেকেই আবার সপরিবার নিয়েও আসছেন খাবার খেতে। হোটেলগুলোতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার খাবার প্যাকেজ। তাতে রয়েছে পেটচুকতি খাবার। যে যেমন পারে ভাত, হাঁসের মাংস ও বিভিন্ন প্রকার সালাত, শাক-সবজি এবং নানান রকমের ভর্তা খেতে।
ভাবিদের হোটেলে প্রতিদিন জবাই হয় ৫০ থেকে ৬০টি হাঁস। বেচাবিক্র হয় দিনে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। তবে সরকারি ছুটির দিনে বেচাবিক্রি আর বেশি হয় থাকে। শহর থেকে একেবারে অজপাড়াগাঁ ভারত সীমান্তে ঘেঁষে এই ভাবির মোড়। তবুও এতো জনপ্রিয়তা বেড়েছে স্থানটির। দেখা যায় হোটেলগুলোতে বসার জায়গা না পেয়ে অনেকেই খাবারের অপেক্ষায় অধির আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে খাবারের অপেক্ষায়। নেই কোন ক্লান্তি বা বিরক্তি। দেখে মনে হবে যেন কোন বিয়ে বাড়ি দাওয়াতে এসেছেন তারা।
জানা যায়, এই স্থানটির নাম ছিলো রাণীর ঘাট। প্রায় ২৫ বছর আগে এই নদীর ঘাটে শুকনা মৌসুমে উত্তোলন হতো বালু। প্রতিদিন এই ঘাটে ৬০ থেকে ৭০ ট্রাক্টর দিয়ে শ্রমিকরা বালু উত্তোলনের কাজ করতেন। তবে রাণীর ঘাটে ছিলো না তখন কোন চা-নাস্তার দোকান। জীবিকার তাগিদে তখন প্রথম জামাল উদ্দিনের স্ত্রী মাসতারা বেগম একটি চায়ের দোকান দেন। ঘাটের রাস্তাটি ছিলো কাঁচা। পরবর্তীতে শুরু হয় রাস্তাটি পাকাকরণের কাজ। রাস্তার শ্রমিকদের জন্য তার ছোট হোটলে শুরু হয় ভাত বেচাবিক্রির। শ্রমিকদের অনুরোধে প্রথমে রান্না করেন একটি হাঁসের মাংস। তার হাতের রান্না খেয়ে মুগ্ধ তারা। এর পর থেকে শুরু হাঁসের মাংস রান্না। অল্প দিনের মধ্যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে মাসতারা বেগমের হাতের সুস্বাদু হাঁসের মাংস রান্নার খবর। পরে তাকে দেখে এলাকার আরও তিন ভাবি হাঁসের মাংসের হোটেল দেন। প্রথম থেকেই এই চার মহিলাকে সবাই ভাবি বলে সম্বোধন করতো । মুলত তখন থেকে হোটেলগুলোর নাম হয় ভাবির হোটেল। আস্তে আস্তে রাণীর ঘাট নামটি পরিবর্তন হয়ে ভাবির মোড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এলাকার মানুষের কাছে। দিনাজপুর জেলা সহ আশপাশের সব জেলার মানুষ এই ভাবির মোড়কে চিনে এবং জানে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ভাবির মোড়ের ভাবিদের হোটেলে হাঁসের মাংস দিয়ে খাবার খেতে।
ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে সপরিবার সহ আসা আজিজার রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি ভাবির মোড়ে ভাবিদের হোটেলের কথা। এখানে নাকি সুস্বাদু হাঁসের মাংস সস্তা দামে পাওয়া যায়। তাই  পরিবারের সকলকে নিয়ে এসেছি। সবাই মিলে খেলাম। আসলে অনেকের মুখে যেমনটি শুনেছি, খাবার খেয়ে তার চেয়ে বেশি স্বাদ পেলাম। ভাবিদের হাতের হাঁসের মাংসর রান্না স্বাদ আসলেই মুখে লেগে থাকার মতো।
দিনাজপুর শহর থেকে আসা সুইটি বেগম বলেন, ভাবিদের হোটেলের রান্নার স্বাদের কথা আর কি বলবো? অসাধারণ, যার তুলোনা শুধুই ভাবিরা। আমি প্রায় সময় এখানকার হোটেলে হাঁসের মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে আসি। মাঝেমধ্যে বাসায় নিজেও চেষ্টা করি তাদের মতো হাঁসের মাংস রান্না করতে। কিন্তু কেন জানি এই স্বাদ খুঁজে পাই না।
বীরগঞ্জ থেকে আসা আশিকুর রহমান বলেন, ভাবির মোড় দিনাজপুর জেলার উত্তর-দক্ষিণের শেষ সীমানায় অবস্থিত। এটা একটি অজপাড়াগাঁ, এখানে কারও আসার কোনই প্রয়োজন হয় না। শুধু ভাবিদের হোটেলের অমরিত স্বাদের খাবার খেতে আসে। তারা অতি যত্নে নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করেন এবং খেয়েও খুবি তৃপ্তি পাই।
ভাবি মাসতারা বেগম সহ চার ভাবি বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ এই মোড়ে আমরা হোটেল ব্যবসা করে আসছি। আমরা সব সময় কাস্টমারের মনপুত ও রুচিসম্মত খাবার পরিবেশন করে থাকি। কাস্টমার আমাদের লক্ষী। জীবনে আমরা এক সময় অনেক অভাবি এবং অসহায় ছিলাম। বর্তমান হোটেল ব্যবসা করে আমরা সবাই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
তারা আরও বলেন, আমরা চার ভাবি মিলেমিশে ব্যবসা করছি। আমাদের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব নেই, সবাই সবার মতো কর্ম করে খাচ্ছি। বর্তমান আমাদের ব্যবসা আগের চেয়ে অনেক ভাল। ছেলেমেয়েদের বড় করে বিয়ে-শাদি দিয়েছি। আমাদের স্বামী তারা আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেন। প্রতিদিন এলাকার বিভিন্ন হাট-বাজার এবং গ্রাম থেকে হোটেলের চাহিদা অনুযায়ী হাঁস সংগ্রহ করেন। আমরা চাই আমাদের হোটেলের সুনাম দেশজুড়ে ছড়িয়ে পরুক। যারা সুস্বাদু হাঁসের মাংস খেতে চান। আশা রাখছি তারা আমাদের ভাবির মোড়ে ভাবিদের হোটেলে চলে আসুন।

শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর

© ২০২০ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | জাগো২৪.নেট

কারিগরি সহায়তায় : শাহরিয়ার হোসাইন