রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইঁদুর নিধনে সংসার চলে আসাদুজ্জামানের

মো. রফিকুল ইসলাম: আমন ধানের ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব নতুন কিছু নয়। ইঁদুরের উৎপাত ও ফসল রক্ষায় কৃষকেরা বিষটোপ, পলিথিনের ঝান্ডা, কলাগাছে লোহার তৈরি ফাঁদসহ আরও বিভিন্ন কৌশল যুগে যুগে ব্যবহার করে আসছেন। তার পরেও কৃষকরা অনেক সময় ইঁদুরের উৎপাত ও ফসল রক্ষা করতে পারেন না। কিন্তু আসাদুজ্জামানের ইঁদুর নিধনের ফাঁদ যেন স্থানীয় কৃষকের নিকট আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। রক্ষা পাচ্ছে কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত ফসল। সেই সঙ্গে জনপ্রিয় ও কার্যকর হয়ে উঠছে ইঁদুর নিধনে পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর বাঁশের তৈরি চোঙার ফাঁদ। কৃষকের ফসল রক্ষা করতে ইঁদুর নিধন করেই সংসার চলছে আসাদুজ্জামানের। ইঁদুর নিধন করেই তার মাসিক আয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এই আয়ের টাকা দিয়েই তার ৩ ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ ৬জনের সংসারের খরচ চলে। ইঁদুর নিধনে তার পুঁজি হিসেবে রয়েছে ৫০টি ফাঁদ ও ফাঁদে ব্যবহারের জন্য সুগন্ধি ধান।

দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার সাঁইতাড়া ইউনিয়নের পূর্ব খোচনা গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে আসাদুজ্জামান (৪৫)। ইঁদুর নিধনে প্রতিদিন কোনো না কোনো কৃষকের ডাক পড়ে তার। গত ৭ বছর ধরে ইঁদুর নিধনের কাজ করছেন তিনি। এতে করে এলাকায় ধানক্ষেতে দিনদিন ইঁদুরের উপদ্রব হ্রাস পাচ্ছে। রক্ষা পাচ্ছে কৃষকের সাধের ও কষ্টের ফসল।কৃষকেরা গত কয়েক বছর ধরে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় প্রযুক্তি ‘বাঁশের চোঙা ফাঁদ’ পদ্ধতির। এতে কৃষকেরা সুফলও পাচ্ছেন। এ বাঁশের তৈরি ইঁদুর নিধনের  চোঙা ফাঁদ পদ্ধতিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন আসাদুজ্জামান।

আসাদুজ্জামান জানান, আমার পিতা ফজলুল হক নিজেদের জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে পরিত্রাণ পেতে কোনো এক আদিবাসীর নিকট বাঁশের তৈরি চোঙা ফাঁদ তৈরি করা শিখে নেন। আমরা নিজেদের ধানক্ষেতের ইঁদুর তাড়ানোর জন্য এই ফাঁদ ব্যবহার করতাম। সেসময় দেখতে পেতাম  গ্রামের লোকজন আমাদের বাড়িতে এসে বাবার নিকট থেকে বাঁশের তৈরি চোঙা ফাঁদ চেয়ে নিতো এবং তাদের ধানক্ষেতে তা বসাতো। দিন দিন এ ফাঁদের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন আমি আমার বাবার নিকট থেকে এ ফাঁদ তৈরি করতে শিখে নিই। প্রথম দিকে এ ফাঁদ ভাড়ায় দিতাম। কিন্তু কৃষকেরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারতো না। পরে নিজেই ভাড়ায় ফাঁদ বসাতে শুরু করি। তখন ফাঁদে একটি ইঁদুর আটকা পড়লে ৩০ টাকা করে নিতাম। এখন ৫০ টাকা করে নিই। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি ফাঁদ বসাই। চলতি আমন মৌসুমে প্রতিদিন এ ফাঁদে ২৫ থেকে ৩০টি ইঁদুর আটকা পড়ে। এ পর্যন্ত একদিনেই ফাঁদে ৩২টি ইঁদুর আটক হওয়ার রেকর্ড আছে। এতে গড়ে প্রতিমাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়। যা দিয়ে আমার ৩ ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ ৬ জনের সংসার চলে।

তিনি আরও জানান, ইঁদুর নিধন করার কারণে অনেকেই আমাকে আদিবাসী, সাঁওতাল, মেথর পর্যন্ত বলে থাকে। কিন্তু আমি কারো কটু কথায় কর্ণপাত না করে এবং আমার স্ত্রীর সহযোগিতায় চোঙা ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর নিধনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়তই এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি মৃত্যুর পূর্ব মূর্হুত পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থে এ ইঁদুর নিধনের কাজটি করে যেতে চাই। ইঁদুর নিধনের কাজটি আমার নেশা ও পেশায় পরিণত হয়েছে। আমি গত ৬ মাসে অন্তত ৩ হাজার ইঁদুর নিধন করেছি।

উপজেলার সাঁইতাড়া ইউনিয়নের পূর্ব খোচনা গ্রামের কৃষক ইয়াকুব আলী জানান, ধানক্ষেতে ইঁদুর আক্রমণ করলে এক বিঘা জমিতে (৪৮ শতাংশ) ২ থেকে ৫ মণ ধান কম হতে পারে। আসাদুজ্জামান ইঁদুর নিধন শুরু করায় এই এলাকায় ক্ষেতের মধ্যে ইঁদুরের উপদ্রব হ্রাস পেয়েছে। এতে শ’ শ’ বিঘা জমির ধান ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাচ্ছে। তিনি এখন আমাদের নয়নমণি। যখনই ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব বৃদ্ধি পায় তখনই তাঁর ডাক পড়ে। তাঁকে ফোন দিলেই তিনি এসে ফসলে ইঁদুর নিধনের কাজ শুরু করে দেন।

উপজেলার বানুপাড়া গ্রামের কৃষক নির্মল চন্দ্র রায় জানান, আসাদুজ্জামান আমার দুইটি ক্ষেতে ইঁদুর নিধনের জন্য ২০টি ফাঁদ পেতে ইঁদুর নিধন করেছে। আমার জমিতে ১১টি ইঁদুর নিধন করায় আমি তাঁকে সাড়ে ৫শ’ টাকা দিয়েছি। তিনি এখন ইঁদুর নিধনের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন।

চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জোহরা সুলতানা জানান, ইঁদুর আমাদের ক্ষেতের ফসলের অনেক ক্ষতি সাধন করে। এখন পর্যন্ত ক্ষেতের ইঁদুর নিধনের যতগুলো পদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে তম্মধ্যে স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত এ বাঁশের চোঙা ফাঁদ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও সবচেয়ে কার্যকর।  আসাদুজ্জামান ইঁদুর নিধন করে কৃষকের ধান রক্ষা করছেন। এজন্য উপজেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মাননা দেয়া হয়েছে।  তিনি ইঁদুর নিধন করে যেমন জীবিকা নির্বাহ করছেন, তেমনি আদিবাসীরা তাঁর নিকট থেকে ইঁদুর ক্রয় করে নিয়ে তাদের মাংসের চাহিদা পূরণ করছেন।

 

জনপ্রিয়

ইঁদুর নিধনে সংসার চলে আসাদুজ্জামানের

প্রকাশের সময়: ০৮:১৩:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫

মো. রফিকুল ইসলাম: আমন ধানের ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব নতুন কিছু নয়। ইঁদুরের উৎপাত ও ফসল রক্ষায় কৃষকেরা বিষটোপ, পলিথিনের ঝান্ডা, কলাগাছে লোহার তৈরি ফাঁদসহ আরও বিভিন্ন কৌশল যুগে যুগে ব্যবহার করে আসছেন। তার পরেও কৃষকরা অনেক সময় ইঁদুরের উৎপাত ও ফসল রক্ষা করতে পারেন না। কিন্তু আসাদুজ্জামানের ইঁদুর নিধনের ফাঁদ যেন স্থানীয় কৃষকের নিকট আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। রক্ষা পাচ্ছে কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত ফসল। সেই সঙ্গে জনপ্রিয় ও কার্যকর হয়ে উঠছে ইঁদুর নিধনে পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর বাঁশের তৈরি চোঙার ফাঁদ। কৃষকের ফসল রক্ষা করতে ইঁদুর নিধন করেই সংসার চলছে আসাদুজ্জামানের। ইঁদুর নিধন করেই তার মাসিক আয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এই আয়ের টাকা দিয়েই তার ৩ ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ ৬জনের সংসারের খরচ চলে। ইঁদুর নিধনে তার পুঁজি হিসেবে রয়েছে ৫০টি ফাঁদ ও ফাঁদে ব্যবহারের জন্য সুগন্ধি ধান।

দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার সাঁইতাড়া ইউনিয়নের পূর্ব খোচনা গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে আসাদুজ্জামান (৪৫)। ইঁদুর নিধনে প্রতিদিন কোনো না কোনো কৃষকের ডাক পড়ে তার। গত ৭ বছর ধরে ইঁদুর নিধনের কাজ করছেন তিনি। এতে করে এলাকায় ধানক্ষেতে দিনদিন ইঁদুরের উপদ্রব হ্রাস পাচ্ছে। রক্ষা পাচ্ছে কৃষকের সাধের ও কষ্টের ফসল।কৃষকেরা গত কয়েক বছর ধরে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় প্রযুক্তি ‘বাঁশের চোঙা ফাঁদ’ পদ্ধতির। এতে কৃষকেরা সুফলও পাচ্ছেন। এ বাঁশের তৈরি ইঁদুর নিধনের  চোঙা ফাঁদ পদ্ধতিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন আসাদুজ্জামান।

আসাদুজ্জামান জানান, আমার পিতা ফজলুল হক নিজেদের জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে পরিত্রাণ পেতে কোনো এক আদিবাসীর নিকট বাঁশের তৈরি চোঙা ফাঁদ তৈরি করা শিখে নেন। আমরা নিজেদের ধানক্ষেতের ইঁদুর তাড়ানোর জন্য এই ফাঁদ ব্যবহার করতাম। সেসময় দেখতে পেতাম  গ্রামের লোকজন আমাদের বাড়িতে এসে বাবার নিকট থেকে বাঁশের তৈরি চোঙা ফাঁদ চেয়ে নিতো এবং তাদের ধানক্ষেতে তা বসাতো। দিন দিন এ ফাঁদের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন আমি আমার বাবার নিকট থেকে এ ফাঁদ তৈরি করতে শিখে নিই। প্রথম দিকে এ ফাঁদ ভাড়ায় দিতাম। কিন্তু কৃষকেরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারতো না। পরে নিজেই ভাড়ায় ফাঁদ বসাতে শুরু করি। তখন ফাঁদে একটি ইঁদুর আটকা পড়লে ৩০ টাকা করে নিতাম। এখন ৫০ টাকা করে নিই। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি ফাঁদ বসাই। চলতি আমন মৌসুমে প্রতিদিন এ ফাঁদে ২৫ থেকে ৩০টি ইঁদুর আটকা পড়ে। এ পর্যন্ত একদিনেই ফাঁদে ৩২টি ইঁদুর আটক হওয়ার রেকর্ড আছে। এতে গড়ে প্রতিমাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়। যা দিয়ে আমার ৩ ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ ৬ জনের সংসার চলে।

তিনি আরও জানান, ইঁদুর নিধন করার কারণে অনেকেই আমাকে আদিবাসী, সাঁওতাল, মেথর পর্যন্ত বলে থাকে। কিন্তু আমি কারো কটু কথায় কর্ণপাত না করে এবং আমার স্ত্রীর সহযোগিতায় চোঙা ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর নিধনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়তই এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি মৃত্যুর পূর্ব মূর্হুত পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থে এ ইঁদুর নিধনের কাজটি করে যেতে চাই। ইঁদুর নিধনের কাজটি আমার নেশা ও পেশায় পরিণত হয়েছে। আমি গত ৬ মাসে অন্তত ৩ হাজার ইঁদুর নিধন করেছি।

উপজেলার সাঁইতাড়া ইউনিয়নের পূর্ব খোচনা গ্রামের কৃষক ইয়াকুব আলী জানান, ধানক্ষেতে ইঁদুর আক্রমণ করলে এক বিঘা জমিতে (৪৮ শতাংশ) ২ থেকে ৫ মণ ধান কম হতে পারে। আসাদুজ্জামান ইঁদুর নিধন শুরু করায় এই এলাকায় ক্ষেতের মধ্যে ইঁদুরের উপদ্রব হ্রাস পেয়েছে। এতে শ’ শ’ বিঘা জমির ধান ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাচ্ছে। তিনি এখন আমাদের নয়নমণি। যখনই ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব বৃদ্ধি পায় তখনই তাঁর ডাক পড়ে। তাঁকে ফোন দিলেই তিনি এসে ফসলে ইঁদুর নিধনের কাজ শুরু করে দেন।

উপজেলার বানুপাড়া গ্রামের কৃষক নির্মল চন্দ্র রায় জানান, আসাদুজ্জামান আমার দুইটি ক্ষেতে ইঁদুর নিধনের জন্য ২০টি ফাঁদ পেতে ইঁদুর নিধন করেছে। আমার জমিতে ১১টি ইঁদুর নিধন করায় আমি তাঁকে সাড়ে ৫শ’ টাকা দিয়েছি। তিনি এখন ইঁদুর নিধনের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন।

চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জোহরা সুলতানা জানান, ইঁদুর আমাদের ক্ষেতের ফসলের অনেক ক্ষতি সাধন করে। এখন পর্যন্ত ক্ষেতের ইঁদুর নিধনের যতগুলো পদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে তম্মধ্যে স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত এ বাঁশের চোঙা ফাঁদ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও সবচেয়ে কার্যকর।  আসাদুজ্জামান ইঁদুর নিধন করে কৃষকের ধান রক্ষা করছেন। এজন্য উপজেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মাননা দেয়া হয়েছে।  তিনি ইঁদুর নিধন করে যেমন জীবিকা নির্বাহ করছেন, তেমনি আদিবাসীরা তাঁর নিকট থেকে ইঁদুর ক্রয় করে নিয়ে তাদের মাংসের চাহিদা পূরণ করছেন।